একনজরে কুরআন কারিম: ৩
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
--
সূরাতু লুকমান!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর আয়াত-নিদর্শনাবলী ও নেয়ামতরাজি, ঈমান ও শোকরের দিকে দাওয়াত বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
শুরুতে প্রজ্ঞাময় কিতাবের কথা। রাব্বুল আলামিনের এককত্বের ওপর যুক্তিপ্রমান পেশ করা হয়েছে। আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, দিনরাত, সাগর-পাহাড়, বৃষ্টি-ঢেউ, গাছপালা-উদ্ভিদসহ এই বিস্তৃত বিশে^র প্রতি বস্তুতে আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা ও কুদরতের সুস্পষ্ট দলিল বিদ্যমান আছে। মানুষের চোখে দৃশ্যমান প্রতিটি বস্তুতে আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের প্রমাণ বিদ্যমান। আল্লাহর কুদরত নিয়ে ভাবলে মনমনন অভিভূত হয়ে যায়। লুকমান হাকিমের আলোচনা করা হয়েছে। তার কিসসায় হেকমতের ফজিলত, শিরকের নিন্দা, মহোত্তম আখলাকের প্রতি উৎসাহ, হীনমন্দ স্বভাবের প্রতি নিরুৎসাহ ফুটে উঠেছে। লুকমানের ঘটনায় বেশি কিছু মূল্যবান নসিহত আছে। শয়তানের আহ্বানের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। গায়বের সংবাদ জানা নিয়ে জ্যোতিষিদের ভ্রান্ত দাবির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
সূরাতুস সাজদা!
মূলবক্তব্য: কুরআনের ব্যাপারে দৃঢ় বক্তব্য উপস্থাপন। তাকদির বাদে ঈমানের মৌলিক ছয়টি উসুল বর্ণনা।
শুরুতে কুরআনের কথা। কুরআনের এজাযের কথা বলা হয়েছে। কুরআন আয়াতসমূহ স্পষ্ট, বিধানসমূহ সমুন্নত। মুশরিকরা অপবাদ দিয়েছিল: কুরআন রাসুলের নিজস্ব বানানো। উর্ধজগত ও নি¤œজগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর কুদরতি নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকরা পুনর্জীবনকে অস্বীকার করে, অকাট্য দলিলের মাধ্যমে তাদের এই ভ্রান্ত বিশ^াসকে রদ করা হয়েছে। কেয়ামতের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে: সেদিন অপরাধীরা লাঞ্ছিত অপদস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে, আখেরাত সম্পর্কে তাদের দৃঢ় একিনের কথা বলবে। হিসাব দিবসের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ মুত্তাকিদের জন্য স্থায়ী নেয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছেন। অপরাধীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।
সূরাতুল আহযাব!
মূলবক্তব্য: মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন, বিশেষ করে পারিবারিক জীবন এই সুরায় গুরুত্ব পেয়েছে। সমাজে সুখ ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তাজ্ঞাপক বিধান জারি করা হয়েছে। জাহেলি যুগ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে চলে আসা কিছু রীতিপ্রথা বাতিল করা হয়েছে: পালকপুত্র, জিহার, একজনের দুটি হৃদপি- থাকা ইত্যাদি। সমাজকে জাহেলি প্রথা থেকে পবিত্র করা হয়েছে। সে যুগে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া কাল্পনিক, মনগড়া কল্পকাহিনী, কুসংস্কার দূর করা হয়েছে।
সুরা আহযাবে আলোচিত বিষয় ও এই সুরার প্রধানতম উদ্দেশ্যকে সংক্ষেপে তিনভাগে ভাগ করা যায়,
১: দিকনির্দেশনা, ইসলাম আদব-শিষ্টাচার বর্ণনা। ওলিমার আদব, আব্রু ও হিজাব, সৌন্দর্য প্রদর্শনী না করা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ওঠাবসার আদবসহ আরো কিছু সামাজিক আদব বর্ণিত হয়েছে। মুমিনের জীবনকে সুখশান্তিময় করতেই মূলত আল্লাহ তাআলা আদবগুলো প্রণয়ন করেছেন।
২. ইলাহি বিধিবিধান। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে সুবিন্যস্ত ও শৃঙ্খলিত করতেই এসব বিধান দেয়া হয়েছে। জিহারে বিধান, পালকপুত্র বিষয়ক বিধান, মিরাসের বিধান, পালকপুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করার বিধান, রাসুলের একাধিক বিবি ও এ ব্যাপারে হেকমত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দুরূদ পাঠের বিধান, শরয়ি হিজাবের বিধান, ওলিমায় দাওয়াত দেয়া সম্পর্কিত বিধানসহ আরো কিছু শরয়ি বিধান আলোচিত হয়েছে।
৩. গযওয়া আহযাব ও গযওয়া বনু কুরায়জা সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা। এ দুই গযওয়া থেকে শিক্ষা ও নসিহত।
সূরাতু সাবা!
মূলবক্তব্য: উপেক্ষা ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ।
শিরকের মূলভিতকেই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন অস্বীকারকারী মুশরিকদের রদ করা হয়েছে। কয়েকজন রাসুলের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমাস সালামের আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন রকমের নেয়ামত আল্লাহ তাদের অনুগত করে দিয়েছিলেন। কওমে সাবার কিসসা বর্ণিত হয়েছে। তারা সুখেশান্তিতে বাস করছিল। তাদের ছিল বাগবাগিচা। নদীনালা। তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ তাদের রাজ্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছেন। তাদেরকে অন্যদের জন্য শিক্ষার বিষয় বানিয়ে দিয়েছেন। খাতামুল মুরসালিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালত সম্পর্কে মুশরিকদের কিছু সন্দেহের কথা বলা হয়েছে। অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে তাদের সন্দেহ রদ করা হয়েছে। মুশরিকদেরকে এক পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আল্লাহরই হাতে সমস্ত সৃষ্টির সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ।
সূরাতুল ফাতির!
মূলবক্তব্য: আকিদার সর্ববৃহৎ বিষয়: আল্লাহর তাওহিদের দাওয়াত। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেশ। শিরকের মূলনীতি সমূলে বিনাশ। কলবকে যাবতীয় মন্দস্বভাব থেকে মুক্ত করে, মহোত্তম আখলাক দ্বারা ভূষিত করার উৎসাহ।
শুরুতে বিশ^জগত সৃষ্টিকারী আল্লাহর কথা। তিনি ফিরিশতা, মানুষ, জি¦ন সৃষ্টি করেছেন। পুনর্জীবনের সপক্ষে এই দৃশ্যমান জগতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য দলিল তুলে ধরেছেন। মুমিন ও কাফেরের মাঝে বিরাট পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে। তাদের দুজনকে অন্ধ ও চক্ষুষ্মাণ, আলো ও আঁধার, ছায়া ও রোদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কুরআন তিলাওয়াতকারী, সলাত কায়েমকারী, গোপনে ও প্রকাশে আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে দানকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। কুরআন পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানি কিতাবের সত্যয়নকারী। উম্মাহ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: জালেম, মধ্যপন্থী সৎকর্মশীল, কল্যাণকাজে তৎপর অগ্রগামী। প্রত্যেকের জন্য শেষদিনের প্রতিদান আছে। মূর্তিপূজার জন্য মুশরিকদের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের এহেন জঘন্য কাজের জন্য তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
সূরাতু ইয়াসিন!
মূলবক্তব্য: উসুলুদ্দীনের মৌীলকতম বিষয়গুলো বিশদ ও পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে: রেসালত, ওহি, কুরআনের মুজিযা, নবিগণের সিফাত, তাকদির, আল্লাহর ইলম, হাশর, তাওহিদ, নেয়ামতদাতার শোকর ইত্যাদি। এগুলো বিশ^াস ও আমলের মাধ্যমে আনুগত্যের মূলনীতি। এসব থেকেই শরিয়তের বিধানসমূহ নির্গত হয়, ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান সাব্যস্ত হয়। পাশাপাশি ব্যক্তি, জীবন ও জগত থেকে বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আকিদার সপক্ষে দলিলও দেয়া হয়েছে। এই সুরাকে কলবুল কুরআন বা কুরআনের হৃদপি- বলা হয়। কারণ, এই সুরায় আলোচিত বিষয়গুলোই পুরো কুরআনের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে আছে।
শুরুতে ওহির শুদ্ধতা ও রেসালতে মুহাম্মদির সত্যতার ওপর কুরআন কারিমের কসম খাওয়া হয়েছে। কাফের কুরায়শের আলোচনা করা হয়েছে। তারা গোমরাহিতে অনঢ় হয়ে ছিল। আল্লাহ তাদের ওপর আযাব অবধারিত করে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছেন। আসহাবে কারইয়াহ বা জনপদবাসীর কিসসা বলা হয়েছে। এ ঘটনা বলে, আল্লাহ ও রাসুলকে অস্বীকার করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। মুমিন দাঈর কথা বলা হয়েছে। তিনি আপন কাওমকে নসিহত করেছিলেন। কওম তাকে শহিদ করে দিয়েছিল। আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করেছেন। আল্লাহ অপরাধীদেরও অবকাশ দেননি। এক বিকট আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আল্লাহ কুদরতের দলিল দেয়া হয়েছে। কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। পুনরুত্থান ও হিসাবের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত ঘটবেই, এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
সূরাতুস সাফফাত!
মূলবক্তব্য: আকিদা ও তাওহিদের মূলনীতি, রেসালত, ওহি, পুনরুত্থান, প্রতিদান বিষয় আলোচনা পেশ করা হয়েছে।
ইবাদতের জন্য সফবন্দী ফিরিশতা ও মুসল্লিগণের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর এককত্বের দলিল দেয়া হয়েছে। শয়তানকে পাথর মেরে বিতাড়ন, জালিমদের লাঞ্ছিতকরণ, অনুগতদের জান্নাতে সম্মানদান, অপরাধীদের জাহান্নামে নিক্ষেপ, নুহের নিদর্শন, ইবরাহিমের আলোচনা, আনুগত্যের প্রতিদান প্রসঙ্গে ইসমাইলের কুরবানি, ইবরাহিমকে ইসহাকের সুসংবাদ, মুসা ও হারুনকে কিতাবদানের মাধ্যমে অনুগ্রহ, দাওয়াত দেয়ার সময় মানুষের অবস্থা, কওমে লুতের ধ্বংস, ইউনুসকে মাছের পেটে আটক বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। জিনদেরকে আল্লাহর সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জুড়ে দেয়া ও ফিরিশতাদেরকে ইবাদতের পর্যায়ে উঠিয়ে আনার ব্যাপারে মুশরিকদের ভ্রান্ত আকিদার অপনোদন করা হয়েছে। আল্লাহ নবিরাসুলকে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছেন। আল্লাহ সমকক্ষ ও সমতুল্য বিপরীত শক্তির অস্তিত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত।
সূরাতু সোয়াদ!
একজনরে
বাতিলের সাথে লড়াই ও তার পরিণতি ঘিরেই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। শুরুতে কাফেররা নবিজির নবুওয়াত নিয়ে অবিশ^াসমূলক বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কাফেরদের দাবি, কুরআন মুহাম্মাদের বানোয়াট বাণী। আসমান ও জমিনের মালিকানা শুধুই আল্লাহর। বিচারদিবসের অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের প্রসঙ্গে দাউদ ও সুলাইমান আ.-এর কিসসা বর্ণিত হয়েছে। ইবতিলা-পরীক্ষা, আরোগ্য, বিপদমুক্তির প্রসঙ্গে আইয়ুব আ.-এর কিসসা তুলে ধরা হয়েছে। ইবরাহিম আ ও তার বংশ থেকে মনোনিত হওয়া নবিদেরকে বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে। জান্নাতুল মাওয়ার অধিবাসীদের ঘটনা বলা হয়েছে। সাকার ও লাযা জাহান্নামে দুর্ভাগাদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আদম-হাওয়া আ. ও ইবলিসের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর বিশেষ মনোনীত নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করার কারণে কাফেরদের প্রতি হুমকি। এই সুরায় বেশকিছু ঝগড়া-বিতর্কের কথা আছে। প্রথম বিতর্ক কাফেরদের সাথে নবিজির। তারপর দাউদ আ.-এর কাছে আসা দুই ব্যক্তির বিবাদ। জাহান্নামবাসীদের পারস্পরিক বিবাদ। মালায়ে আলা বা উর্ধজগতবাসীদের মতভিন্নতা। আদমের ব্যাপারে ইবলিসের বিবাদ। আদমসন্তান ও তাকে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে ইবলিসের বিবাদ।
সূরাতুয যুমার!
একনজরে
মূলবক্তব্য: তাওহিদ ও ইখলাসের দাওয়াত। শিরক প্রত্যাখ্যান।
শুরুতে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। দ্বীন ও ঈমানের ক্ষেত্রে ইখলাসের আলোচনা করা হয়েছে। মূর্তিপূজার ব্যাপারে কাফেরদের ভ্রান্ত অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে। কোনও খুঁটি বা স্তম্ভ ছাড়াই বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আল্লাহ তাআলা আসমান সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ আসমান থেকে নেয়ামত বর্ষণ করে বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করছেন। কোনও সাহায্য ছাড়াই আল্লাহ মায়েদের উদরে সন্তানকে হেফাজত করেন। কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার জন্য মানুষ উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। রাতের আঁধারে রহমানের ইবাদতে মশগুল তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সবরকারীদের প্রতিদান, ক্ষতিগ্রস্তদের লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে। মুখলিস ও আল্লাহর মারেফাত হাসিলকারীদের জন্য জান্নাতে বাড়তি আবাসনব্যবস্থা থাকবে। মুমিনদের অন্তরকে তাওহিদ ও ঈমানের নুর দ্বারা আলোকিত করা হবে। সত্যবাদীদেরকে উত্তম প্রতিদান ও ক্ষমার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। মূর্তিসমূহ তাদের পূজারীদের কোনো সাহায্য করতে পারে না। সেগুলো পুরোপুরি অক্ষম ও অথর্ব। স্বপ্ন ও ঘুমের বিস্ময়কর বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এক আল্লাহর কথা শোনার ব্যাপারে কাফেরদের বেজায় অনীহা। ঈমানদারদের জন্য আছে আল্লাহর রহমতের সুসংবাদ, অবাধ্যদের জন্য আছে ক্ষতি ও পরিতাপ। বিকট ও ভয়ংকর আওয়াজে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব দৃশ্যমান হবে। পরিপূর্ণ ইনসাফ কায়েম হবে। কাফেরদেরকে লাঞ্ছনা ও অপমানজনক পদ্ধতিতে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মুমিনগণ জান্নাতে সম্মানজনক বাসস্থানে আনন্দে থাকবে। সৃষ্টির মাঝে ইনসাফের সাথে ফয়সালা করা হবে। অনুগ্রহ ও এহসানকারী আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা।
সূরাতুল মুমিন-গাফের!
মূলবক্তব্য: হক ও বাতিল, হেদায়াত ও গোমরাহির লড়াই।
এজন্য সুরার ভাষাভঙ্গিতে তীব্রতা ও প্রচ-তার ছাপ পাওয়া যায়। আয়াতগুলোর আবহ দেখলে মনে হয় যেন যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে। তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা-তিরস্কার করা হয়েছে। অত্যাচারী সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণতি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাদের দম্ভ ও ক্ষমতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি ক্ষমা দিয়ে অনুগ্রহ করেন, তাওবা কবুল করেন। আরশ বহনকারী ফিরিশতাগণের কথা বলা হয়েছে। কাফেররা জাহান্নামের তলদেশে কান্নাকাটি করবে। কেয়ামত দিবসে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হবে। পূর্ববর্তী জালেম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। অত্যাচারী ফেরাওনকে মুসা আলাইহিস সালাম দাওয়াত দেয়ার ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঈমান ও অবাধ্যতার কিসসা বলা হয়েছে। ফেরাওন তার দাপট প্রতাপের সাহায্যে মুসা ও তার অনুসারীদের সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছিল। সে ভয় করেছিল, তার নিজের সম্প্রদায়ের মাঝে মুসার ঈমানি দাওয়াত ছড়িয়ে পড়বে। এই সুরায় মুসা ও ফেরাওনের ঘটনার এক নতুন দিক বেরিয়ে এসেছে, অন্য কোনো সুরায় এই প্রসঙ্গ নেই। তা হল, ফেরাওন পরিবার থেকে এক মুমিন ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ। এতদিন মানুষটা তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন। প্রথমে কোমল ও সতর্কভাবে পরে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীনভাবে ঈমানের কথা প্রকাশ করেছেন সাহসী মানুষটা। ফেরাওন সাঙ্গপাঙ্গসহ সাগরে ডুবে মরেছে। সেই দাঈসহ অন্য মুমিন মুক্তি পেয়েছেন।
আল্লাহর বড়ত্ব, মহিমা এককত্বের পরিচয়বাহী দৃশ্যমান জাগতিক কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। মিথ্যাচারী, অবাধ্য, সীমালঙ্ঘনকারী, দাম্ভিকদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহবিমুখ ও গাফেল থাকাবস্থায় তাদেরকে আল্লাহর আযাব এসে পাকড়াও করেছিল।
সূরাতু হামীম সাজদা!
মূলবক্তব্য: আকিদার হাকিকত বর্ণনা করা হয়েছে। তাওহিদুল উলুহিয়ত, শেষদিন, ওহি, রেসালত বিষয়ক আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। এটা করা হয়েছে, জাগতিক কিছু নিদর্শন, পূর্ববর্তীদের করুণ পরিণতি, কেয়ামতের কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে।
শুরুতে কুরআনের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। কাফেররা এই কুরআন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আসমান ও জমিন সৃষ্টির পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইশারায় আদ ও সামুদ ধ্বংসের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। কেয়ামতদিবসে অবাধ্যদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। কাফেররা জাহান্নামে বড় অসহায় ও অক্ষম অবস্থায় থাকবে। মুমিনগণকে স্থায়ী জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আযান দেয়া মুয়াজ্জিনগণ সম্মানের অধিকারী। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রহমানের এককত্বের ওপর দলিল পেশ করা হয়েছে। কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে। লাভ-ক্ষতি, মন্দকর্ম ও সৎকর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইবতিলা-পরীক্ষার সময় কাফেররা বড় অস্থির হয়ে পড়ে। রব্বে কারিমের কুদরতের পরিচয়বাহী নিদর্শন প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্য ও গোপন সমস্ত কিছুর জ্ঞান রাখেন।
সূরাতুশ শুরা!
মূলবক্তব্য: উম্মাহর ঐক্য আবশ্যক। শুরার গুরুত্ব।
তাওহিদের সপক্ষে দলিল পেশ করা হয়েছে। রাসুলের নবুয়ত ও ইসলামি শরিয়তকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেয়ামতের নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। দুনিয়া-আখেরাতে আমলকারীদের প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। রিজিক নির্ধারণ ও বণ্টনের হেকমত বর্ণনা করা হয়েছে। পাপের অকল্যাণকর দিক সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে। মানুষকে ক্ষমাকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। হিসাব নেয়ার সময় কাফেররা লাঞ্ছিত-অপদস্থ হবে। সন্তানদানের মাধ্যমে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নবিগণের ওপর ওহি নাযিলের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান দান করে, রহমান তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সবকিছুর চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন এক আল্লাহর দিকে।
সূরাতুয যুখরুফ!
মূলবক্তব্য: দুনিয়ার ফিতনা ও তার চাকচিক্যের ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
শুরুতে কুরআনের সত্যতা প্রমাণ। উম্মি নবির ওপর এই কুরআন বিশুদ্ধতম ভাষায়, সুস্পষ্ট বর্ণনাভঙ্গিতে নাযিল করা হয়েছে। আসমান-জমিন, পাহাড়পর্বত, সাগর-নদী, সাগরে চলমান নৌযান, গোশত খাওয়া ও আরোহণযোগ্য মানুষের অনুগত গবাদিপশুতে আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের দলিল বিদ্যমান। জাহেলি যুগের কিছু কুসংস্কার, মূর্তিপূজা, কল্পকাহিনী বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জাহেলি যুগের মানুষ কন্যাসন্তান অপছন্দ করত। অথচ আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত। এটা ছিল তাদের নির্বুদ্ধিতা ও নিছক অজ্ঞতা। তারা ফেরেশতাগনকে আল্লাহর কন্যা মনে করত। কুরআন তাদের এই ভ্রান্ত অমূলক ধারণ শুধরে দিয়েছে।
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে। মক্কার মুশরিকরা মনে করত, তারা ইবরাহিমের বংশধর। তারা ইবরাহিমের ধর্মের ওপর অধিষ্ঠিত আছে। তাদের এহেন দাবিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ইবরাহিমই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। রিজিক বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত দিবসে কাফেরদের অনুতাপ, অনুশোচনার কথা বলা হয়েছে। মুসা ও ফেরাওনের মুনাজারার কথা বলা হয়েছে। ফেরাওন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডুবে মরেছে। বিচারদিবসে তাওহিদের অনুসারীরা সম্মানিত হবে। কাফেররা অক্ষম অবস্থায় আযাবে নিমজ্জিত হবে। আসমান ও জমিনে প্রকৃত উলুহিয়ত আল্লাহর। রাসুলকে কাফেরদের উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।
সূরাতুদ দুখান!
মূলবক্তব্য: দ্বীন অস্বীকারকারীদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের আযাবের ভয় দেখিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
কদরের রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। এই বরকতময় রাতের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এই রাতে সৃষ্টির বিষয়াদি নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। তারা কুরআনের ব্যাপারে ঘোরতর সন্দিহান। অথচ কুরআনের আয়াতসমূহ অত্যন্ত স্পষ্ট, দলিলগুলো অকাট্য ও সহজবোধ্য। মুশরিকদেরকে কঠিন আযাবের হুমকি দেয়া হয়েছে। কওমে ফেরাওনের কথা বলা হয়েছে। তাদের ওপর আযাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেমে এসেছিল। তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর, তাদের কীর্তি ও কর্মের নিদর্শন অবশিষ্ট থেকে গেছে। বাগবাগিচা, নদীনহর, প্রস্রবণ-ঝরনা-কূপ থেকে গেছে। বনি ইসরায়েল এসবের উত্তরাধিকারী হয়েছে। আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে, বনি ইসরায়েল এসব সুযোগসুবিধা থেকে বিতাড়িত হয়ে মিসর ছাড়া হয়েছে।
মক্কার মুশরিক কুরাইশ পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে। কুরাইশ পূর্ববর্তী অত্যাচারী ও দাম্ভিক-দাপুটে জাতিসমূহ থেকে তো আর বেশি শক্তিশালী নয়। আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। বেশি সম্মানিত নয়। অপরাধী অবাধ্য জাতিগোষ্ঠিকে ধ্বংসের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতিতে কখনো পরিবর্তন আসে না। শেষে পুণ্যবানদের অবস্থান ও পাপীদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে তরগিব ও তরহিব, তাবশির ও ইনজারের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
সূরাতুল জাসিয়া!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর কুদরত বর্ণনার মাধ্যমে, এককত্বের ওপর সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন।
কুরআন কারিমের কথা বলা হয়েছে। এই বিস্তৃত পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু জাগতিক আয়াতের কথা বলা হয়েছে। অপূর্ব অভিনব সৃষ্টি আসমানে নিদর্শন আছে। বিস্তৃত পৃথিবীতে নিদর্শন আছে। মানুষ, জীবজন্তু ও অন্যান্য মাখলুকের মাঝে নিদর্শন আছে। রাতদিনের আবর্তনে নিদর্শন আছে। বায়ু ও বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে নিদর্শন আছে। প্রতিটি সৃষ্টিই আল্লাহর অপার কুদরত ও বড়ত্বের নিরব স্বাক্ষী।
তারপর কুরআন অস্বীকারকারী অপরাধীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কুরআনের আলোকিত আয়াত শোনার পর তাদের অহংকার ও অবাধ্যতা আরো বেড়ে যায়। তাদেরকে জাহান্নামের তলদেশে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে। বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অফুরন্ত নেয়ামত ঢেলে দিয়েছেন। যেন তারা শুকরিয়া আদায় করে, তাদের ওপর উপচে পড়া আল্লাহর নেয়ামত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। আল্লাহ বনি ইসরায়েলকে নানা রকমের সম্মান, নেয়ামতে ভূষিত করেছিলেন। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণাকে কুফরি ও অবাধ্যতা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। সম্মানিত রাসুলগণের দাওয়াতের ব্যাপারে অপরাধী ও অবাধ্যদের অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহর ইনসাফি মানদ-ে অপরাধী আর সৎকর্মশীল, পুণ্যবান আর দুষ্ট সমান নয়।
মুশরিকদের ভ্রষ্টতার কারণ বলা হয়েছে। তাদের নানাবিধ অপরাধ ও প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করার কারণে, তাদের অন্তর্দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হক-বাতিল পার্থক্য করার মানদ- অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। কেয়ামত দিবসে মানুষকে ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। সেদিন মানুষ দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যাবে: একদল জান্নাতে, আরেকদল জাহান্নামে।
সূরাতুল আহকাফ!
মূলবক্তব্য: ইসলামি আকিদার তিন মৌলিক বিষয় আলোচিত হয়েছে। তাওহিদ, রেসালত-ওহি, পুনরুত্থান ও প্রতিদান।
কুরআনের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের পূজ্যপাদ মূর্তির কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের বিশ^াস, আল্লাহর পাশাপাশি এসব মূর্তিও তাদের উপাস্য। মূর্তিগুলো আল্লাহর কাছে তাদের সপক্ষে সুপারিশ করবে। যারা শোনে না, উপকার করতে পারে না, তাদের পূজা করা নিছক ভ্রষ্টতা। মুশরিকরা কুরআনের ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল তাদের এই চরম ভ্রান্ত বিশ^াস রদ করা হয়েছে।
হেদায়াত ও গোমরাহি হিসেবে দুই প্রকার মানুষের নুমনা পেশ করা হয়েছে,
প্রথম নমুনা: নেকসন্তান। সরল সঠিক ফিতরতের অধিকারী। মাতাপিতার প্রতি অনুগত ও সদাচারী। তার বয়েস যত বাড়ে তার তাকওয়া, সদাচারিতা, সততা, মাতাপিতার প্রতি এহসানও বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয় নমুনা: বদ ও দুর্ভাগা সন্তান। ফিতরত বা জন্মগত স্বভাব থেকে বিচ্যুত। মাতাপিতার প্রতি দুর্ব্যবহারকারী ও অবাধ্য। ঈমান ও আখেরাতকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে।
উভয় সন্তানের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। হুদ ও সীমালঙ্ঘনকারী আদ জাতির কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। কওমে আদ পৃথিবীতে নৈরাজ্য কায়েম করেছিল। আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল। নিজেদের শক্তি-সামর্থ, দাপট-প্রতাপ দ্বারা ধোঁকা খেয়ে আত্মম্ভরি হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তাদেরকে কল্যাণহীন বন্ধ্যা তীব্র বায়ু দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন। এই ধ্বংসের ঘটনা বলে মক্কার মুশরিক কুরাইশকে সতর্ক করা হয়েছিল। তারা আল্লাহর আদেশ পালনে অহংকার করেছিল। আল্লাহর রাসুলকে মানতে অস্বীকার করেছিল। শেষে একদল জিনের কিসসা বলা হয়েছে। তারা কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করে ঈমান এনেছিল। তারপর আপন কওমে গিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছিল। ঈমানের দিকে দাওয়াত দিয়েছিল। জিনের ঘটনায় তখনো পর্যন্ত ঈমান না আনা মানুষের প্রতি সতর্কবার্তা ও উপদেশ ছিল। জিন হয়েও তাদের আগে ঈমান এনে ফেলেছে। তারা মানুষ হয়েও ঈমানে পিছিয়ে পড়েছে।
সূরাতু মুহাম্মাদ!
মূলবক্তব্য: কিতাল, বন্দী, গনিমতের বিধান ও মুনাফিকের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। মোটাদাগে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এই সুরার মূল আলোচ্যবিষয়।
আল্লাহ, তার রাসুল ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের শত্রুদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাফেররা রাসুলকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। রাসুলের দাওয়াতের প্রতিবন্ধক হয়েছিল। তারা মানুষকে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছিল।
মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতালের হুকুম দেয়া হয়েছে। পৃথিবীকে কুফরের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করতে, কাফেরদেরকে মুজাহিদের তরবারি দ্বারা প্রতিহত করতে বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যেন কাফেরের কোনও ধরণের শক্তি-দাপট না থাকে। কাফেরদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা ও জখম করার পর বন্দী করতে বলা হয়েছে। ইজ্জত ও সম্মানের পথ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মুমিন বান্দাকে আল্লাহ সাহায্য করার শর্তাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। শর্ত হল, আল্লাহর শরিয়ত আঁকড়ে ধরা ও আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করা।
মক্কার কাফেরদের উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তী অত্যাচারী সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তারা অপরাধ ও সীমালঙ্ঘন করার পর, আল্লাহর তাদেরকে কীভাবে ধ্বংস করেছেন, সেটা বলা হয়েছে। মুনাফিকরদে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জঘন্য হুমকি। মানুষকে মুনাফিকের ধোঁকা-প্রতারণা, চক্রান্ত-কূটকৌশল থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, মুনাফিকের কুকীর্তি, বদখাসলত ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। শেষে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের মাধ্যমে ইজ্জত ও বিজয়ের পথ আঁকড়ে ধরতে মুমিনদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। জীবন ও জীবিকার লোভে ইসলামের শত্রুদের সাথে আপস করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, নশ^র, ক্ষয়িষ্ণু। আল্লাহর কাছে যা আছে সেটা চিরস্থায়ী। অবিনশ^র।
সুরাতুল ফাতহ!
মূলবক্তব্য: হোদায়বিয়ার সন্ধি। ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুল ও মুশরিক কুরায়শের মাঝে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তি ফতহে মক্কা বা মক্কাবিজয়ের পথ তৈরি করেছিল।
মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আরবে মুসলমানদের বিজয়, সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা পেয়েছিল। মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। মুমিনগণের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাইআতে রিদওয়ানের কথা আছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলের হাতে আমৃত্যু জিহাদের বাইআত দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের জীবনে ও ইসলামের ইতিহাসে এই বাইআত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা এই বাইআতে অকল্পনীয় বরকত দান করেছিলেন। এতে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের প্রতি আল্লাহ ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তাদের কথা খোদ কুরআন কারিমে স্থান দিয়েছেন। ওহির নুরানি বাক্য দ্বারা তাদের এই মহাকীর্তি চিত্রিত করেছেন।
কিছু গ্রাম্য বেদুইন অন্তরের ব্যাধির কারণে রাসুলের সাথে হোদায়বিয়ার সফরে বের হয়নি। বেদুইনের মতো মুনাফিকরাও পিছিয়ে ছিল। তারা রাসুল ও মুমিনদের সম্পর্কে মন্দধারণাবশত এই সফরে বের হয়নি। তাদের মনের গোপন অভিসন্ধি ফাঁস করে তাদেরকে লাঞ্ছিত অপদস্থ করা হয়েছে। রাসুল বিজয়ের সুসংবাদবাহী স্বপ্ন দেখেছিলেন। নবিজি দেখেছিলেন, তিনি নিরাপদে নিশ্চিন্তে মক্কায় প্রবেশ করছেন। স্বপ্নটির বিবরণ জানতে পেরে, সাহাবায়ে কেরামকে ভীষণ আশাবাদী আর উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকে আপন রেজামন্দি দ্বারা সম্মানিত করেছেন। ইসলামের জন্য জিহাদ, সবর ও ত্যাগের কারণে তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাত দ্বারা বিভূষিত করেছেন।
সূরাতুল হুজুরাত!
মূলবক্তব্য: ইসলামি সমাজের আখলাক সমুন্নত করা। মন্দস্বভাবের ব্যাপারে সতর্ক করা। সুরাটি আকারে ছোট হলেও, প্রকারে অনেক বড়। দ্বীন ও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ চিরন্তন সব আদব-আখলাক বর্ণিত হয়েছে। তরবিয়ত ও সহবতের শাশ^ত নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে। নাগরিক জীবনের মৌলিক বিধি বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে হুজুরাতকে সুরাতুল আখলাকও বলা হয়।
শুরুতেই মুমিনদেরকে আল্লাহ, রাসুল ও শরিয়তের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও শরিয়তের চেয়ে আগে বাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলের উপস্থিতিতে মুমিনগণ পাকাপোক্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, আগে বেড়ে নিজস্ব কোনো মতামত জাহির করবে না, সামষ্টিক কোনো বিষয়ে ফয়সালা করবে না। আগে রাসুলের সাথে পরামর্শ করবে, রাসুলের প্রাজ্ঞ দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করবে।
রাসুলের সামনে কথাবার্তা বলার সময় স্বর উঁচু করবে না। রাসুলের সম্মান বজায় রাখবে। নবিজির অবস্থানের দিকে লক্ষ্য রাখবে। নবিজি ছাড়া অন্য বড়দের ক্ষেত্রেও এই আদব প্রযোজ্য। খাস-নির্দিষ্ট আদব বর্ণনার পর আম-উন্মুক্ত আদব বর্ণনা করা হয়েছে। গুজব-রটনার দিকে ভ্রƒক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা ও অনুসন্ধানের পন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। বিশেষ সংবাদটা যদি অনির্ভরযোগ্য, অনিরাপদ, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি থেকে ছড়ায়। নির্বিচারে গুজবে কান দেয়ার কারণে, মানুষ অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়। পারস্পরিক ফাটল-অনৈক্য সৃষ্টি হয়। দুই বিবদমান, ঝগুড়ে ব্যক্তির মাঝে আপস সৃষ্টি করে দিতে বলা হয়েছে। সীমালঙ্ঘনকারী, জালিমের জুলুম রোধ করতে বলা হয়েছে। অন্যকে উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, খোঁচা মারা, ছিদ্রান্বেষণ, কটাক্ষ করতে নিষেধ করা হয়েছে। গিবত ও দোষত্রুটি খোঁজার জন্য গোয়েন্দাগিরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যের সম্পর্কে মন্দধারণা করতে নিষেধ করা হয়েছে। উম্মত আখলাখে ভূষিত হতে বলা হয়েছে। ঈমানি ভ্রাতৃত্বের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিছু গাঁইয়া বেদুইন মনে করত, মৌখিকভাবে কালিমা পড়ার নাম ঈমান। ঈমানের হাকিকত স্পষ্ট করা হয়েছে। ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার শর্তাবলী বলা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন