একনজরে কুরআন কারিম: ২
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
----
সূরাতুর রাদ!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর শক্তি-কুদরতের হাকিকত ও তার প্রকাশ। প্রতিশ্রুতি ও ভীতিপ্রদর্শন। জীবন ও জগতের পরিবর্তন-পরিবর্ধনে আল্লাহর সুন্নাহ বা কর্মকৌশল।
আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর কিতাব, রাসুল, পুনরুত্থান ও শেষ প্রতিদানের প্রতি ঈমান রাখার মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। উলুহিয়ত, উবুদিয়তের অর্থ বলা হয়েছে। আল্লাহ এক, তিনিই একমাত্র রিজিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা। তিনিই একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত। জ্ঞান ও মারেফাত হাসিলের মাধ্যম তিনটি,
১: ওহি।
২. আকল।
৩. অনুভূতি বা ইন্দ্রিয়।
প্রথমটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। বাকিদুটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে গায়বি বিষয়ে। বস্তুর বাহ্যিক রূপ থেকে ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়। প্রতিটি বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার ভেতরের রূপ যাচাই করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। শুরুতে আল্লাহর অস্তিত্ব ও এককত্বের প্রতি ঈমান রাখার কথা। কুরআন সুস্পষ্ট সত্য হওয়া সত্ত্বেও মুশরিকরা কুরআনকে মিথ্যা মনে করেছিল। আল্লাহর একত্বকে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহর কুদরতের পূর্ণতা, সৃষ্টির বিশালতার কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টি, জীবন ও মৃত্যু দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে, পুনর্জীবন ও শেষ প্রতিদানের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। তারপর হক ও বাতিলের দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলের নবুয়ত ও রেসালতের সাক্ষ্যদান বিষয়ক আরেকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। নবুয়ত একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
সূরাতু ইবরাহিম!
মূলবক্তব্য: রাসুল একাধিক হলেও, সবার রেসালতের হাকিকত এক।
কুরআনের এজাযের কথা বলা হয়েছে। এজায মানে অক্ষম করা। কুরআন কারিমের মতো আরেকটি কুরআন সৃষ্টি করতে মানুষ অক্ষম। মোটাদাগে এটিই এজাজুল কুরআনের মূলনির্যাস। কুরআনের মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। মুসা আলাইহিস সালামের রেসালতের কথা, কওমকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তার শুকরিয়া আদায়ের দাওয়াত দানের কথা বলা হয়েছে। রাসুলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। যুগে যুগে আগত রাসুলগণ ও তাদের কওমের কথা বলা হয়েছে। রাসুলগণ ও তাদের কওমের মাঝে সংঘটিত কথোপকথন, বিতর্কের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ জালেমদের ধ্বংস করেছেন। আখেরাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন দুর্ভাগা অপরাধীরা তাদের দুর্বল অনুসারীদের মুখোমুখি হবে। সেদিন দুই পক্ষের দীর্ঘ কথোপকথন, কথা কাটাকাটি হবে। সবাইকে জড়ো করে জাহান্নামে ফেলা হবে। নেতাদের উদ্দেশ্যে অনুসারীদের লানত বর্ষণ সেদিন কোনো কাজে আসবে না। নেতা ও কর্মী কেউ বাঁচতে পারবে না। কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবে না। ঈমানি কালিমা ও ভ্রষ্ট কালিমার দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। উভয়টাকে তুলনা করা হয়েছে উত্তম বৃক্ষ ও অনুত্তম বৃক্ষের সাথে। শেষে শেষদিন জালিমদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
সুরাতুল হিজর!
মূলবক্তব্য: মিথ্যাচারী কাফেরদের জন্য অপেক্ষমান ভয়াবহ পরিণতি স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। এটা করা হয়েছে দুই ভাবে,
ক. মিথ্যাচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতি আলোচনার মাধ্যমে।
খ. জগতে দৃশ্যমান আল্লাহর কুদরত ও বড়ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে।
শুরুতে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। তারপর নবিগণের দাওয়াতের কথা বলা হয়েছে। দুর্ভাগা ভ্রষ্টদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি নবিকেই তাদের ভ্রষ্ট কওম উপহাস করেছে। এটাই সর্বকালে মিথ্যাচারীদের সুনান কা কর্মকৌশল। বিস্ময়কর জগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীর কথা বলা হয়েছে। আসমান, জমিন, পরাগরেণুবাহী বায়ু, জীবন ও মৃত্যু, হাশরনশর-প্রতিটিই আল্লাহর কুদরত ও বড়ত্ব প্রকাশকারী নিদর্শন। আল্লাহর এককত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষী। আদম ও তার ঘোরতর শত্রু ইবলিস সৃষ্টির ঘটনার মধ্য দিয়ে হেদায়াত ও গোমরাহির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর ইবরহিম, লুত আ. আসহাবে আইকা, আসহাবে হিজরের কথা বলা হয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসা আযাবের বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুলকে কুরআনের মতো বড় নেয়ামত দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুশরিকদের দেয়া কষ্টে রাসুলকে সবর করতে বলা হয়েছে। সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। নবিজি ও মুমিনদেরকে আসন্ন বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সূরাতুন নাহল!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি নেয়ামতই নেয়ামতদাতার পরিচয় বহন করে। হিজরকে সুরাতুন নিয়াম বা নেয়ামতের সুরা বলা হয়। কারণ আল্লাহ এই সুরার শুরুতে নেয়ামতসমূহের মূলনীতি বা কায়েদা বর্ণনা করেছেন। সুরার শেষে নেয়ামতের পূর্ণতা ও পরিণতিদানকারী বিষয়সমূহ উল্লেখ করেছেন।
সুরায় আকিদার বড় বড় বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে: উলুহিয়ত, ওহি, পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান ইত্যাদি। এই বিশাল জগতে, আসমান-জমিনে, সাগর-পাহাড়ে, সমতল-উপত্যকায়, বর্ষিত পানি ও বৃষ্টিতে, বর্ধমান উদ্ভিদে, সাগরে চলমান নৌযানে, রাতের আঁধারে পথিকদের পথনির্দেশক তারকায় আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের দলিল বিদ্যমান। মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চক্ষু ও কর্ণের মাধ্যমে এসব নিদর্শন ক্রমাগত দেখে যায়। এগুলো আল্লাহর নেয়ামত ও নিদর্শনের জীবন্ত চিত্র, আল্লাহর এককত্বের প্রমাণ, জগতসৃষ্টিতে আল্লাহর অপূর্ব কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার ও শোকর আদায় না করার ফলাফল স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। অস্বীকারকারী ও হঠকারি, একগুঁয়ে ব্যক্তির জন্য যে ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। রাসুলকে হেকমত ও উত্তম কথার মাধ্যমে দাওয়াত দেয়ার আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহর বানী প্রচারের সময় সম্মুখিন হওয়া দুঃখযাতনায় সবর করতে বলা হয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে প্রভূত প্রতিদান অপেক্ষমান আছে।
সুরাতু বনি ইসরায়েল!
মূলবক্তব্য: কুরআন কারিমের মর্যাদা, রেসালতে মুহাম্মদির পূর্ণতা বর্ণিত হয়েছে।
শুরুতে ইসরা-মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মেরাজের ঘটনা ছিল নবিজির প্রতি আল্লাহর সম্মান প্রদানের সুস্পষ্ট নিদর্শন, আশ্চর্যজনক ঘটনা সৃষ্টিতে আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। বনি ইসরায়েল সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাদের বিশৃঙ্খলা ও অবাধ্যতার কারণে দুই বার তাদেরকে আপন বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়াটা আল্লাহ অবধারিত করে দিয়েছেন। খালেক বা সৃষ্টিকর্তার এককত্ব ও কুদরতের পরিচয়বাহী কিছু মহাজাগতিক নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। শরয়ি কিছু আদব ও মহোত্তম আখলাকের কথা বলে এগুলোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করতে বলা হয়েছে। মুশরিকদের গোমরাহি সম্পর্কে বলা হয়েছে। তারা আল্লাহর জন্য সঙ্গীনি ও সন্তান সাব্যস্ত করেছিল। বিস্ময়ের বিষয় হল, তারা নিজেদের জন্য কন্যাসন্তান অপছন্দ করলেও, আল্লাহর জন্য ঠিকই কন্যা সাব্যস্ত করত। অথচ আল্লাহ সমস্ত সাদৃশ্য, সমদর্শিতা থেকে পবিত্র। পুনরুত্থান, পুনর্জীবন ও প্রতিদান সম্পর্কে বলা হয়েছে। এসব তখন বিষয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। আল্লাহ কেয়ামত, হিসাব, প্রতিদানের অবশ্যম্ভাবিতার সপক্ষে অকাট্য দলিল প্রমাণ তুলে ধরেছেন। তারপর কুরআন কারিম সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুশরিকরা বিভিন্ন হঠকারি প্রস্তাবনা পেশ করেছিল। তারা কুরআন কারিম ছাড়া অন্য মুজিযা দাবি করেছিল। সুরার শেষে আল্লাহকে যাবতীয় শরিক ও সন্তানমুক্ত মহাসম্মানিত ঘোষণা করা হয়েছে। যাবতীয় অসম্পূর্ণতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, অক্ষমতা-দুর্বলতা থেকে পবিত্র বলা হয়েছে। আল্লাহকে নিরংকুশ সম্মান ও মহিমার অধিকারী বলা হয়েছে। এই কুরআন শব্দটি ১১ বার আলোচিত হয়েছে। আর কোনো সুরায় এতবার শব্দটি উল্লেখিত হয়নি। এতে একটি সূক্ষè ইঙ্গিত আছে বলে মনে করা হয়: একটি পরিপূর্ণ কুরআনি প্রজন্ম ছাড়া কুদসের চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব নয়।
সূরাতুল কাহফ!
মূলবক্তব্য: ফিতনা থেকে সুরক্ষা।
দুনিয়ার জীবনে মুমিনকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অসংখ্য ফিতনার সম্মুখিন হতে হয়। একের পর এক ফিতনা আসতেই থাকে। ফিতনার তোড়ে পরম ধৈর্যশীলও অনেক সময় হয়রান হয়ে যায়। শাসকের ফিতনা, যৌবনের ফিতনা, পরিবার-পরিজনের ফিতনা, সম্পদের ফিতনা, সন্তানের ফিতনা, নশ^র দুনিয়ার ধোঁকাময় ফিতনা, ইবলিসের ফিতনা, ইলমের ফিতনা, ইয়াজুজ-মাজুজের ফিতনা, প্রবৃত্তির ফিতনা।
সুরা কাহফে এসব ফিতনা ও এগুলোর ঝুঁকির কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে। আমাদের সামনে ফিতনা থেকে সুরক্ষার পথ তুলে ধরা হয়েছে, মুক্তির পথ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা সম্ভব হবে রব্বানি মানহাজ অনুসরণ, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা ও আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আশ্রয় গ্রহণ, আমাদের চেতনা, চিন্তা ও বুঝশক্তির মানদ- বিশুদ্ধকরণ, জীবনের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ, সৎসঙ্গ অবলম্বন, দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র-এই আকিদা পোষণ, উপকারি ইলম দ্বারা নিজেকে সুরক্ষিতকরণ, বিশুদ্ধ ইবাদত দ্বারা পাথেয় গ্রহণ, সবর ও অবিচলতা অবলম্বন, মহোত্তম আখলাক ধারণ, পূর্ববর্তীদের কাসাস থেকে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। এসব গুণাবলী মুমিনকে আখেরাতের বিপদ থেকে রক্ষা করে, ঠিক যেমনিভাবে কাহফ বা গুহা মানুষকে হিং¯্র বন্যপ্রাণী ও বিপদাপদ থেকে সুরক্ষা ও আশ্রয় দেয়। প্রাকৃতিক কাহফের মতো এই সুরাও পাঠকারীর জন্য যাবতীয় ফিতনা থেকে সুরক্ষাদানকারী গুহার ভূমিকা পালন করবে। আমার কর্তব্য এই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করা। তাহলে রব্বে কারিম আমার ওপর তার রহমত বিস্তার করবেন।
এই সুরায় অপূর্ব তিনটি কুরআনি কাসাস বর্ণিত হয়েছে। কাসাসগুলো বর্ণনার প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে: আকিদা পোক্ত করা, আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত সুদৃঢ় করা,
প্রথম কিসসা: আসহাবে কাহফের কিসসা। নিজের বিশুদ্ধ আকিদা সুরক্ষিত রাখার জন্য জানমাল উৎসর্গ করা। একদল মুমিন যুবক নিজেদের দ্বীন ও ঈমান বাঁচাতে সমাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন পাহাড়ের গুহায়। সেখানে ৩০৯ বছর একটানা ঘুমিয়ে ছিলেন। তারপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
দ্বিতীয় কিসসা: মুসা ও খিজির আলাইহিমাস সালামের কিসসা। ইলম তলবের জন্য বিনয় অবলম্বন করা, মেহনত ও সফর করার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কিছু গায়বি বিষয় মুসার আগেই খিজিরকে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছিলেন।
তৃতীয় কিসসা: জুলকারনাইনের কিসসা। তিনি ছিলেন একজন মুত্তাকি ও ইনসাফকারী বাদশাহ। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার শাসনক্ষমতা ছড়িয়ে ছিল। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। তিনি এক মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।
সুরা কাহফে চার প্রকার ফিতনার কথা বলা হয়েছে। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় ফিতনা আর হতে পারে না,
১: দ্বীনের ফিতনা। আসহাবে কাহফ এই ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে এই ফিতনা থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারা দ্বীন ও ঈমান নিয়ে কুফরপূর্ণ সমাজ-রাষ্ট্র থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
২. সম্পদের ফিতনা। দুই বাগিচার মালিকদ্বয় এই ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিল। একজন বাগানমালিক এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল। আল্লাহ তার সম্পদ নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন।
৩. ইলমের ফিতনা। খিজির ও মুসা আলাইহিমাস সালামের কিসসায় এই ফিতনার স্বরূপ ফুটে উঠেছে। খিজির ইলম পেয়ে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।
৪. ক্ষমতা ও রাজত্বের ফিতনা। জুলকারনাইনের কিসসায় এই ফিতনার স্বরূপ উঠে এসেছে। তিনি এই ফিতনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এতবড় নেয়ামতের শোকর আদায় করার কারণে আল্লাহ তাকে ফিতনা থেকে মুক্ত রেখেছিলেন। তিনি তার সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করেছিলেন। যাবতীয় ক্ষমতা তিনি মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করেছিলেন।
এই সুরায় কয়েকটি বাস্তবনির্ভর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সম্পদ ও ক্ষমতার আধিক্যের সাথে হকের কোনো সম্পর্ক নেই। হকের সম্পর্ক বিশুদ্ধ আকিদার সাথে।
প্রথম দৃষ্টান্ত: আপন ধন-সম্পদ নিয়ে দম্ভকারী ধনাঢ্য ব্যক্তি ও আকিদা ও ঈমান নিয়ে আপন শক্তিতে বলিয়ান গরিব ব্যক্তি। এটা দুই বাগান মালিকের ঘটনায় ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব, ধ্বংসশীলতা।
তৃতীয় দৃষ্টান্ত: অহংকার ও দম্ভ। ইবলিস আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করত অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ কারণে সে বিতাড়িত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল।
এসব গল্প ও কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে মূলত আমাদের উপদেশ ও নসিহার জন্য।
সূরাতু মারয়াম!
মূলবক্তব্য: সুরা মারয়ামে দুটি সিফাতের কথা আলোচিত হয়েছে। দুটি সিফাতই একটি অপরটির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। একটি অপরটির জন্য আবশ্যকও বটে।
১: রহমত বা দয়া। এই সিফাত আল্লাহ তাআলা যে পরিপূর্ণ রব, তার বাস্তব প্রমাণ। জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া ও মায়া জড়িয়ে আছে। প্রতিটি সৃষ্টিতে রব্বে কারিমের রহমত অনবরত উপচে পড়ছে।
২. উবুদিয়ত-দাসত্ব। আল্লাহর দাসত্বই একজন মানুষকে পূর্ণতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেয়। এই সিফাতের মাধ্যমে মানুষ তাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়। আল্লাহর উবুদিয়তে নিহিত আছে, সম্মান, উত্তরণ, মুক্তি, স্বাধীনতা,পরিশুদ্ধি, বিন¤্রতা, আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাময় আত্মমগ্ন আত্মনিবেদন।
রহমত আল্লাহ তাআলা পূর্ণ রুবুবিয়তের পরিচায়ক হলে, বিশুদ্ধ ও পূর্ণ উবুদিয়ত হল মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরম ইবাদতগুজার সিদ্দিকা মারয়ামকে তার আম্মা আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতের জন্য মানত করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন মারয়াম। এর অর্থ আবেদা-ইবাদতগুজার মেয়ে। আল্লাহ তার বন্ধুদেরকে স্বীয় রহমত দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছেন। এই সুরায় বর্ণিত রাসুলগণের আলোচনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, মুমিন তার পরিবার-পরিজন, সন্তান ও পরবর্তী বংশধরদের সততার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে।
শুরুতে যাকারিয়া ও সন্তান ইয়াহয়া আলাইহিমাস সালামের কথা বলা হয়েছে। অতি বৃদ্ধ পিতা যাকারিয়ার ঔরস ও বন্ধ্যা মাতার গর্ভ থেকে আল্লাহ ইয়াহয়ার জন্ম দিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি দুঃখি হাহাকার ভরা দোয়া শোনেন, শোকাকুল ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন। তারপর কুমারি মারয়ামের অত্যন্ত বিস্ময়কর আর অবিশ^াস্য কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তারপর ইবরাহিম ও তার পিতার কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা, হারুন, ইসমাঈল, ইদরিস ও নুহ আলাইহিমুস সালামের গুণবর্ণনামূলক প্রশংসা করা হয়েছে। তারপর কেয়ামতের কিছু ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শেষে আল্লাহকে সন্তান ও শরিক থেকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। মুশরিকদের গোমরাহি সুস্পষ্ট ভাষা ও অকাট্য দলিলের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই সুরায় ‘রহমান’ সিফাতটি ১৬ বার উল্লেখিত হয়েছে। রহমত শব্দটি ৪ বার উল্লেখিত হয়েছে। এর মাধ্যমে যেন বোঝানো হয়েছে, এই সুরার মূল মাকসাদ বা উদ্দেশ্য: মুমিনের আকিদায় আল্লাহর রহমত সিফাতটির প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি মুশরিকদের রদ করাও উদ্দেশ্য ছিল। মুশরিকরা আল্লাহ তাআলার ‘রহমান’ সিফাতটি অস্বীকার করত। সুরা ফুরকানে আছে,
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمُ اسْجُدُوۡا لِلرَّحْمٰنِ قَالُوْا وَ مَا الرَّحْمٰنُ ٭
৬০
সূরাতু তোয়াহা!
মূলবক্তব্য: দ্বীনের দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য বাছাইকৃত রাসুলগণ ও তাদের অনুসারীদের প্রতি আল্লাহর তত্ত্বাবধান ও যাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতি কোমলতা আর গুরুত্ব প্রদর্শন।
এ বিষয়ের নুমনা হিসেবে মুসা আলাইহিস সালামও অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী ফেরাওনের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। রবের কাছে মুসার মুনাজাতের কথা বলা হয়েছে। মুসাকে রেসালতের দায়িত্ব দেয়ার কথা আছে। মুসা ও ফেরাওনের বিতর্কের কথা আছে। মুসা ও জাদুকরদের লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ফুটে উঠেছে, আল্লাহ তার প্রিয় নবিকে আগলে রেখেছিলেন, নিজ তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। তার শত্রুদের ধ্বংস করেছিলেন। যারা ছিল কাফের, অপরাধী। সংক্ষেপে আদম আলাইহিস সালামের কথা বলা হয়েছে। ভুল করার পরও আল্লাহ আদমের প্রতি রহমত নাযিল করেছেন। তাদের হেদায়াত দান করেছেন। হাশর দিবসের কথা আছে। সেদিন ইনসাফের সাথে হিসাবনিকাশ হবে। আনুগত্যকারীরা সন্তুষ্টচিত্তে জান্নাতে চলে যাবেন। অবাধ্যদেরকে জাহান্নামে জড়ো করা হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সবর করতে বলা হয়েছে। বিজয় আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট সহ্য করতে বলা হয়েছে।
সূরাতুল আম্বিয়া!
মূলবক্তব্য: তাওহিদের নিদর্শনাবলী, নবিগণের দাওয়াতে পুনর্জীবনের প্রসঙ্গ ও এ বিষয়ে মানুষের অবস্থান।
মানুষ আখেরাত সম্পর্কে গাফেল অথচ কেয়ামত অতি সন্নিকটে। মিথ্যাচারীদের কথা বলা হয়েছে। তারা বিগতদের পরিণতি দেখার পরও শিক্ষা গ্রহণ করে না। জীবন ও জগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর এককত্বের সাক্ষ্যদানকারী আল্লাহর কুদরতের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। তারা নবি-রাসুলকে উপহাস করত, মিথ্যা সাব্যস্ত করত। অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীক ভঙ্গিতে ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, লুত, নুহ, দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইসমাঈল, ইদরিস, যুলকিফল, ইউনুস, মুসা, হারুন, যাকারিয়া ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভীতি ও হুমকিও প্রদর্শন করা হয়েছে। তাদের কিসসায় নসিহত ও ইবরতও আছে। তাদের কিসসা থেকে কেবল বিশুদ্ধ অন্তর ও চিন্তার অধিকারী মানুষই কেবল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালতের কথা বলা হয়েছে।
সূরাতুল হজ!
মূলবক্তব্য: উম্মাহ গঠনে হজ ফরজ করার ভূমিকা।
কেয়ামতকালে ঘটিতব্য ভয়ানক ভূমিকম্পের কথা বলা হয়েছে। পুনর্জীবনের সপক্ষে দলিল দেয়া হয়েছে। কেয়ামতের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন পুণ্যবানরা জান্নাতে, পাপীরা জাহান্নামে যাবে। বায়তুল্লাহর পবিত্রতা ও হজ ফরজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। হজের উপকারিতা, হজের বিধান, হজের শাআয়ের বা প্রতীক, হজসাধন পদ্ধতি, কুরবানির জন্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতালের অনুমতি দেয়ার হেকমত সম্পর্কে বলা হয়েছে। জুলুম ও অবাধ্যতার কারণে বিধ্বস্ত হওয়া জনপদসমূহের আলোচনার মাধ্যমে, মিথ্যাচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতি তুলে ধরা হয়েছে। এসব বলে মুসলিমদের সান্ত¡না দেয়া হয়েছে যে, সবরকারীদের জন্য উত্তম পরিণতি অপেক্ষা করছে। মূতিপূজারী মুশরিকদের উদ্দেশ্যে দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। এসব ভ্রান্তু উপাস্যগুলো শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী মানুষ সৃষ্টি তো দূরের কথা, একটি মাছি সৃষ্টিতেও অক্ষম। মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
সূরাতুল মুমিনুন!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর এককত্ব প্রমাণ। শিরক ও তার নীতিমালাসমূহ বাতিল করা হয়েছে। ঈমান ও শরিয়তের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঈমানদারদের সাফল্যের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। ঈমানদারদের কীর্তি ও উন্নত আখলাক-ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। এসবের বিনিময়ে মুমিনগণ জান্নাতুল ফিরদাওস লাভ করবেন। আল্লাহর কুদরতের দলিল পেশ করা হয়েছে। কয়েকজন নবির কিসসা বলা হয়েছে। এসব বলে আমাদের নবিজিকে সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সপক্ষে দলিলপ্রমাণ পেশ করা হয়েছে। অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বাতিলকে রদ করা হয়েছে। মৃত্যুর সময় কাফের যে ভয়ানক পরিস্থিতি ও যন্ত্রণার সম্মুখিন হয়, তার কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত দিবসে মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা।
সূরাতুন নূর!
মূলবক্তব্য: চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও দোষত্রুটি ঢেকে রাখা। মুসলিম ব্যক্তি-সমাজ গঠন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়-পালনীয় কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে। পরিবার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও দিকনির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। বৃহত্তর সমাজ গঠনে পরিবার বীজের ভূমিকা পালন করে। পরিবার সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সুরায় পরিবারিক সমস্যা-সংকট, পরিবারব্যবস্থা বিধ্বংসী বিষয়সমূহের সমাধান করা হয়েছে। এছাড়াও আছে মহোত্তম আদব-আখলাক, গভীর প্রজ্ঞা, গুরুত্বপূর্ণ দিকনিদের্শনা, উত্তম জীবন গঠনে সহায়ক হেকমতপূর্ণ নসিহত। এজন্য ওমর রা. কুফাবাসীর কাছে লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘তোমরা নারীদেরকে সুরা নুর শিক্ষা দাও’।
যেনা, অপবাদ, লেআনের হুদুদ বর্ণনা করা হয়েছে। শরিয়তের কিছু আদব ও আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে। যথা, ঘরে প্রবেশের সময় অনুমতি প্রার্থনা, দৃষ্টি অবনত রাখা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করার কথা বলা হয়েছে। বেগানা নারী ও পুরুষের মেলামেশা হারাম করা হয়েছে। মুসলিম পরিবার গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান চারিত্রিক নিষ্কলুষতা। প্রতিটি মুসলিম পরিবারে পবিত্রতা ও পর্দাপুশিদা থাকা উচিত। সমাজের শুদ্ধতা শুরু হয় ইবাদতের প্রভাবে। ইবাদতের মূল হল: সলাত। সলাতে আসে কলবের পবিত্রতা। পবিত্র আত্মা ছাড়া বিশুদ্ধ সমাজ গঠিত হয় না। মসজিদ ও তার অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। মসজিদ আবাদকারী, মসজিদে আগমনকারী, মসজিদের সাথে লেগে থাকা ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সূরাতুল ফুরকান!
মূলবক্তব্য: কুরআনের মুজিযার মাধ্যমে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতার প্রমাণ দেয়া হয়েছে। আকিদা বিষয়ক আলোচনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআন ও রাসুলের রেসালত সম্পর্কে মুশরিকদের সন্দেহ অপনোদন করা হয়েছে। কুরআনের সত্যতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। দলিল দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে, কুরআন রবের পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন ও প্রতিদান সাব্যস্ত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী মিথ্যাচারী কওমে মুসা, নুহ, আদ, সামুদ ও আসহাবে রসসের ভয়াল পরিণতির চিত্র আঁকা হয়েছে। তাদের ওপর নেমে এসেছিল নানা প্রকারের আযাব। তাদের অবাধ্যতা ও আল্লাহর রাসুলকে অস্বীকার করার কারণে এই আযাব দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের সপক্ষে দলিল দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও উন্মুক্ত বিশে^ ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে। রহমানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে প্রশংসনীয় আখলাক দ্বারা সম্মানিত করেছেন। যার বিনিময়ে তারা জান্নাতে বিরাট প্রতিদানের উপযুক্ত হবেন।
সূরাতুশ শুআরা!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর রাসুলকে অস্বীকারে অনঢ়, রাসুলের রেসালতের সমালোচনাকারী, রাসুলগণের অসম্মানকারী ব্যক্তিদের প্রতিরোধ করা হয়েছে।
শুরুতে কুরআন কারিমের আলোচনা। আল্লাহ মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনে আছে মানবতার যাবতীয় রোগ-বালাইয়ের আরোগ্যনিদান। কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। মুসা থেকে শুরু করে শোয়াইব আলাইহিমুস সালামের কাসাস বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রেসালত প্রচার করতে গিয়ে তারা যে কষ্ট ও সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে। শয়তানের বন্ধুদের ওপর রহমানের বন্ধুদের বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, কুরআন শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। তাদের এই অমূলক ধারণা রদ করা হয়েছে।
সূরাতুন নামল!
মূলবক্তব্য: রাসুলকে আল্লাহ তাআলা বৃহত্তম নিদর্শন কুরআন দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন। এজন্য রাসুলকে শোকর আদায় করতে উৎসাহ দিয়েছেন। সবরের সাথে এই কুরআন প্রচার করতে বলেছেন।
শুরুতে কুরআনের বালাগাত বা আলংকারিক সৌন্দর্য, ব্যাপক অর্থময়তা, কুরআনের মর্যাদা বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কিছু নবির কাসাস সংক্ষেপে, কিছু নবির কাসাস বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে। সুলাইমান আলাইহিস সালামের রাজত্বের কথা বলা হয়েছে। তার কিসসায় আছে ক্ষমতা ও রাজদ-ের অধিকারীদের জন্য সূক্ষè শিক্ষা। সুলাইমান রাজশক্তিকে আল্লাহর দিকে দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার যুগে বাস করা প্রতিটি জালেম ও কাফের শাসককে তিনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। একই ঘটনা ঘটেছিল রাণী বিলকিসের ক্ষেত্রে। বিলকিস দাওয়াত পেয়ে মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছিলেন। রহমানের দাওয়াতে বিলকিস সসৈন্যে অনুগত বশীভূত হয়ে সুলাইমানের কাছে এসেছিলেন। সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত ও একতত্বের দলিল দেয়া হয়েছে। হাশরদিনের ভয়ংকর কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ এসব দেখে সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: সৌভাগ্যবান, পুণ্যবান, কাফের ও ফাসেক।
সূরাতুল কাসাস!
মূলবক্তব্য: অহংকারীদের ধ্বংস, দুর্বলদের সাহায্য করার ব্যাপারে, আল্লাহর সুনান-কর্মকৌশল ও কুদরত প্রকাশের মাধ্যমে শক্তির প্রকৃত মানদ- বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই সুরা নাযিলের সময় মক্কায় সীমিত সংখ্যক মুসলিম অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ছিলেন। মুশরিকরা শক্তি ও দাপটে প্রবল ছিল। তখন শক্তি ও মূল্যবান হওয়ার প্রকৃত মানদ- পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই জগতে একটাই মাত্র শক্তি আছে-আল্লাহর শক্তি। এই জগতে একটাই মাত্র মূল্যবান বস্তু আছে-ঈমান। যার সাথে আল্লাহর শক্তি আছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে একা হলেও তার কোনো ভয় নেই। যার সাথে আল্লাহর শক্তি নেই, তাকে দুনিয়ার সবাই সাহায্য করলেও, তার কোনো শান্তি ও নিরাপত্তা নেই। যার সাথে ঈমান আছে, তার সাথে সমস্ত কল্যাণ আছে। যার কাছে ঈমান নেই, কোনো কিছুই তার জন্য উপকারী হতে পারে না।
হক ও বাতিলের কথা বলা হয়েছে। আনুগত্য ও অবাধ্যতার কথা বলা হয়েছে। হিযবুর রহমান ও হিযবুশ শয়তানের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুটি কিসসা বলা হয়েছে,
১: শাসনক্ষমতা ও প্রতিপত্তি পেয়ে সীমালঙ্ঘন করা। অত্যাচারী ফেরাওনের ঘটনায় এটা ফুটে উঠেছে। সে বনি ইসরায়েলকে চরম নির্যাতন করেছিল। শিশুদের জবাই করে, নারীদের জীবিত রাখত। আল্লাহর ওপর অহংকার করে বলেছিল (اَنَا رَبُّكُمُ الْاَعْلٰی) আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব (নাযিআত: ২৪)। আল্লাহ তাকে সাগরে ডুবিয়ে মেরেছেন। তারা জুলুমের কারণেই মুসাকে তার সাগরে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন ফেরাওনকে সেই শাস্তি ভোগ করতে হল।
২. ধনসম্পদ দিয়ে অহংকার, দম্ভ করা। কারুন তার কওমের সাথে এমন করেছিল।
উভয় ঘটনাই ইহজীবনে মানুষের অবাধ্যতার নিদর্শন। একটাতে সম্পদের দম্ভ, আরেকটাতে ক্ষমতার দম্ভ। মক্কার কাফেরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তারা রাসুলের দাওয়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ভ্রষ্টদের পথচলা ও পরিণতি এক। সৌভাগ্যের পথ দেখানো হয়েছে। সেটা হল ঈমানের পথ। এই পথের দিকেই সম্মানিত রাসুলগণ মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন।
সূরাতুল আনকাবূত!
মূলবক্তব্য: ইবতিলা-ফিতনা বা পরীক্ষার সময় সবরের সাথে অবিচল থাকা। ইবতিলা বা পরীক্ষা এই জীবনেরই অনিবার্য অংশ। মুসলমানরা মক্কায় চূড়ান্ত কষ্ট ও নির্যাতনের মাঝে ছিলেন। এজন্যই ফিতনা-ইবতিলা মানে পরীক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে নবিগণের কিসসাও বর্ণনা করা হয়েছে। তারা অবিশ^াস্য চেষ্টা-মুজাহাদা করেছিলেন। অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছিলেন।
নুহ আলাইহিস সালাম সাড়ে নয়শ বছর কওমকে দাওয়াত দিয়েছেন। অল্প কজন ছাড়া বাকিরা কেউ ঈমান আনেনি। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার কওমের পেছনে সর্বাত্মক মেহনত করেছিলেন, তাদের সাথে যুক্তিতর্ক দিয়ে লড়াই করেছিলেন। কাজ হয়নি। কওম ইবরাহিমের সাথে অবাধ্যতা করেছিল। সীমালঙ্ঘন করেছিল। কওমে লুত কোনও লাজলজ্জা ছাড়াই ন্যক্কারজনক অশ্লীল কাজ করত। বিভিন্ন আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালতের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের কিছু দলিল দেয়া হয়েছে। কষ্টের দিনে সবরকারীদের জন্য প্রতিদান আছে। জানমাল দিয়ে মেহনতকারী ও ইবতিলা-মেহনত-পরীক্ষার সময় অবিচল থাকা ব্যক্তিদের জন্যও সম্মানজনক প্রতিদান আছে। হক ও দ্বীনের সাহায্যে আত্ম ও অর্থত্যাগের যথোপযুক্ত প্রতিদান আছে।
সূরাতুর রূম!
মূলবক্তব্য: সুরা রূম মানুষের অবস্থা ও জীবনের নানা ঘটনার মাঝে গভীর যোগসূত্র উন্মোচন করে দেখায়। মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র দেখিয়ে দেয়। জগতের রীতিনীতি ও অস্তিত্বের নিয়মনীতির মাঝে যোগসূত্র দেখিয়ে দেয়। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি জন্মসৃষ্টি, প্রতিটি জয়-পরাজয় এক সূক্ষè সুবিন্যস্ত বন্ধনে আবদ্ধ। জগতের সবকিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে,
لِلهِ الْاَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَ مِنْۢ بَعْدُ
রূম: ৪
শরুতেই এক গুরুত্বপূর্ণ গায়বি সংবাদ দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটার আগেই কুরআন সংবাদটি জানিয়ে দিয়েছে: পারস্যের ওপর রোমকদের বিজয়। হিযবুর রহমান ও হিযবুশ শয়তানের মাঝে লেগে থাকা চিরন্তন যুদ্ধের হাকিকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মানবসৃষ্টির সূচনা থেকেই এই যুদ্ধ চলে আসছে। যতদিন হক ও বাতিল, ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, ইসলাম ও কুফরের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন যুদ্ধ থামবে না। শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গদের জড়ো করে যাবে: আল্লাহর নুরকে নেভানোর জন্য, রাসুলগণের দাওয়াতের বিরোধিতা করার জন্য।
কেয়ামতের ভয়াবহতা এবং সেদিন কাফের ও ভ্রষ্টদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুমিনগণ সেদিন জান্নাতে আনন্দে মগ্ন থাকবে। অপরাধীদের আযাবে হাজির করা হবে। আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের পরিচয়বাহী জাগতিক কিছু দৃশ্য ও গায়বের কিছু দলিল তুলে ধরা হয়েছে। কাফের কুরায়শ সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাদের দেয়া কষ্টে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবর করতে বলা হয়েছে। আল্লাহর সাহায্য আসবেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে বলা হয়েছে। এই সুরার সবচেয়ে বড় কথা হল: আল্লাহ তাআলা মানুষকে দ্বীন ইসলামের ওপরই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কিছুর তালাশ করাটা, আল্লাহর সৃষ্টি বদলে দেয়ার নামান্তর। এ এক ভয়ংকর বিকৃতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন