একনজরে কুরআন কারিম: ১
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
----
সূরাতুল ফাতিহা
কুরআন কারীমের সবচেয়ে অর্থবহ সুরা। সুরাটি আয়াতের স্বল্পতা আর আকারে হ্রস্ব হওয়া সত্বেও, সংক্ষেপে পুরো কুরআন তো বটেই, সমস্ত আসমানি কিতাবেরও সারনির্যাস ধারণ করে আছে। এই সুরায় আছে- দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা ও শাখাগত বিষয়াবলী, শরীয়তের বিধান, শেষদিনের প্রতি ঈমান, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, একমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ও দোয়া করা, আল্লাহর দিকে অভিমুখী হয়ে আল্লাহর কাছে সত্যদ্বীনের হেদায়াত-পথনির্দেশ ও সিরাতে মুস্তাকিম-সরলপথ প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে কাকুতিমিনতি করে ঈমান ও সালেহিনের অনুসৃত পথের ওপর অটল থাকাও দোয়ার প্রসঙ্গ। গযবগ্রস্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার দোয়াও আছে। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের কিসসা আছে। সৌভাগ্যবানদের উচ্চমর্যাদা ও দুর্ভাগাদের অধঃপতিত স্তর বর্ণিত হয়েছে। সুরা ফাতিহায় আছে শরীর ও হৃদয়ের আরোগ্য।
তাওহিদে রুবুবিয়ত, তাওহিদে উলুহিয়ত, তাওহিদে আসমা ও সিফাতের প্রসঙ্গ আছে। নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ আছে। শেষবিচারে কর্মফলের কথা আছে। তাকদিরের কথা আছে। যাবতীয় বেদাতি ও গোমরাহ দলের প্রতি রদ আছে। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি অনুগত্যের আদেশ আছে। আল্লাহর ইবাদতের পদ্ধতি বলা হয়েছে। সৃষ্টির ওপর ¯্রষ্টার হকের বর্ণনা আছে। ¯্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির প্রয়োজন ও মুখাপেক্ষিতার কথা আছে। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিন্যাস আছে। এই সম্পর্কের সূচনায় রহমত, মাঝে হেদায়াত, শেষধাপে থাকে নেয়ামত। পুরো কুরআনে যা কিছু আছে, সবই সুরা ফাতিহার তাফসির। সুরা ফাতিহা অন্য সব সুরার মায়ের মতো। এজন্য ফাতিহাকে উম্মুল কিতাব বলা হয়। কারণ এই সুরায় পুরো কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে। অন্য কোনো সুরা ফাতিহার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো নয়। অন্য কোনো সুরা এই সুরার শূন্যতা পূরণ করার মতোও নয়। তাওরাত ও ইনজিলে এই সুরার মতো সমতুল্য কিছু নাযিল হয়নি।
আল্লাহ তাআলা বহু কিতাব নাযিল করেছেন। সব কিতাবের বক্তব্য যাবুর, তাওরাত ও ইনজিল এই তিন কিতাবে সমাহার ঘটিয়েছেন। এই তিন কিতাবের নির্যাস কুরআনে জমা করেছেন। কুরআনের নির্যাস সুরা ফাতিহায় জমা করেছেন। সুরা ফাতিহাকে জমা করেছেন,
আমরা আপনারই ইবাদত করি, আপনার কাছেই সাহায্য চাই (৪)।
সুরাতুল বাকারা!
কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ সুরা। এই সুরায় একহাজার আদেশ, একহাজার নিষেধ, একহাজার হুকুম, একহাজার খবর-সংবাদ আছে। পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফাহ বা প্রতিনিধিত্বকে ঘিরেই পুরো সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। কারা যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করেছেন, কারা করেনি-এই দুই শ্রেণিই মূলত সুরার প্রধান চরিত্র।
শরিয়তের মূলনীতি বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতের নিয়মকানুন বর্ণিত হয়েছে। মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সামাজিক, রাষ্ট্রিক, পারিবারিক জীবনের বিধিবিধান আলোচিত হয়েছে। ইলমের মূলনীতি, দ্বীনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। কুরআন কারীমের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন আয়াত ‘আয়াতুল কুরসি’, কুরআন কারীমের সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াত ‘আয়াতুদ দাইন’ বা ঋণের আয়াত এই আছে। ইসলামি আকিদা, ইবাদত, মুআমালা, আখলাক, নিকাহ, তালাক, দুগ্ধপান করানো, ইদ্দতসহ শরিয়তি বিধান বিষয়ক বেশিরভাগ আয়াত এই সুরায় উল্লেখিত হয়েছে। পুরো সুরার আলোচ্যবিষয়কে ছয়টি মূলধারায় প্রকাশ করা যেতে পারে,
১: কুরআনের সত্যতার কথা বলা হয়েছে। কুরআনের দাওয়াত সত্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. কুরআনি হেদায়াত গ্রহন ও বর্জনের দিক থেকে মানুষ তিন প্রকার: মুমিন, কাফের, মুনাফিক। ঈমান, কুফর ও নিফাকের হাকিকত বর্ণিত হয়েছে।
৩. আদম আ.-এর কিসসার মধ্য দিয়ে মানুষের সৃষ্টির গোড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনের যেসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল, তার বর্ণনা আছে।
৪. আহলে কিতাব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বিশেষ করে ইহুদিদের সম্পর্কে। কারণ মদিনায় তারাই মুসলমানদের প্রতিবেশি ছিল। ইহুদিদের আকিদাবিশ^াস নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদের ওপর আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে ইহুদিদের ধোঁকা-প্রবঞ্চনা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ইহুদিদের অন্তর্গত স্বভাবজাত নিচুতা, গাদ্দারি, বিশ^াসঘাতকতা, ওয়াদাচুক্তি-অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রবণতার কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে। ইহুদিদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, একথা বোঝানো হয়েছে।
৫. সুরার দ্বিতীয়ার্ধে শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণিত হয়েছে। মদিনায় হিজরতের পর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মেহনত শুরু হয়েছিল। এসময় আইনকানুন জানার প্রয়োজন ছিল তীব্র। চাহিদার প্রেক্ষিতেই নাযিল করা হয়েছিল-কিসাস, সিয়াম, হজ-ওমরা, জিহাদ, নিকাহ, তালাক, ইদ্দত রেজাআত, যাকাত-সদকা, বেচাকেনা, সুদের বিধান।
৬. সুরার শেষে মুমিনদেরকে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইনাবতের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে কাকুতিমিনতি করে কান্নাকাটি করতে বলা হয়েছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে সাহায্য চাইতে বলা হয়েছে।
সূরাতু আলে ইমরান!
পুরো সুরার আলোচনা আল্লাহর ওয়াহদানিয়ত বা এককত্বকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এ বিষয়ে আকলি ও নকলি দলিল পেশ করা হয়েছে। মোটাদাগে দ্বীনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ আর মৌলিক রোকন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে,
১: আকিদা বিষয়ক আলোচনা। আল্লাহর এককত্বের ওপর দলিল-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
২. শরিয়তের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে মাগাজি-জিহাদ বিষয়ক বিধান।
প্রথম বিষয়: আল্লাহর এককত্ব, নবিগণের নবুয়ত, কুরআনের সত্যতা বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলাম, কুরআন ও মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে আহলে কিতাবের উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেয়া হয়েছে। ঈসা মাসিহ সম্পর্কে খ্রিস্টানদের বিতর্ক তুলে ধরা হয়েছে। তারা ঈসাকে ইলাহ মনে করত। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে অস্বীকার করত। সুস্পষ্ট দলিল ও অকাট্য দলিল দিয়ে তাদের ভ্রান্ত চিন্তা রদ করা হয়েছে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে ইশারায় ইহুদিদের নিন্দা করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে আহলে কিতাবের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়: শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে। হজ ফরজ হওয়া, জিহাদ, সুদ হারাম হওয়া, যাকাত প্রদানে অনীহ ব্যক্তির বিধান আলোচিত হয়েছে। গযওয়া বদর ও ওহুদের আলোচনা আছে। এসব যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সঠিক আকিদা ও মানহাজের ওপর অবিচল থাকার উপায় বলা হয়েছে। তাওহিদ ও আল্লাহর কাছে দোয়া-রোনাজারির মাধ্যমেই এটা সম্ভব। জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকার উপায় বলা হয়েছে। আল্লাহ ও রাসুলের অনুগত্য, দুনিয়ার সাথে জড়িয়ে না পড়া, আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরা ও বিভক্ত না হওয়ার মাধ্যমে এটা সম্ভব।
সুরার শেষে কিছু বিষয় নিয়ে তাদাব্বুর করতে বলা হয়েছে। আসমান, জমিন ও এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তা নিয়ে তাদাব্বুর করতে বলা হয়েছে। আসমান-জমিন সৃষ্টিতে আল্লাহর শিল্পনৈপুণ্য, অপূর্ব কৃতকৌশল, বিস্ময়কর গঠনশৈলী, অজানা রহস্য নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। আসমান-জমিনের এমন নিখুঁত সৃষ্টি একজন পরাক্রমশালী ¯্রষ্টার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। জিহাদ ও মুজাহিদিনের কথা বলা হয়েছে। এক পরিপূর্ণ সারগর্ভ উপদেশ দেয়া হয়েছে। এটা মেনে চলতে পারলে, সার্বিক কল্যাণ লাভ হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবে। পূর্ণতম সাফল্য লাভ হবে,
ٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا ۟ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
আলে ইমরান: ২০০
সুরাতুন নিসা
মূলবক্তব্য: সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণ, জাহেলি যুগের রীতিনীতি দূরীকরণ, নারী ও দুর্বলের অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে, মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকে বিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল করা।
নারী, ঘর, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। তবে, এই সুরায় বেশিরভাগ আলোচনা নারীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এজন্য সুরার নামকরণও নারীর নামে হয়েছে। শুরুতে নারী, এতিম ও মিরাসের আলোচনা। বংশ, দুধপান ও বিয়ের সূত্রে হারাম হয়ে যাওয়া নারীগণ। দাম্পত্য সম্পর্ককে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আত্মিক ও মানবিক সম্পর্কও বটে। মোহর নিছক মজুরি বা প্রতিদান নয়, এটি ভালোবাসা বর্ধক উপহার। মোহর আদায়ের মাধ্যমে দুজনের সহাবস্থান সুন্দর, সুখকর হয়, আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
স্ত্রীর ওপর স্বামীর, স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকের কথা বলা হয়েছে। স্বামী তার স্ত্রীর ওপর কাউয়াম-তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। এই তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব স্ত্রীকে দাসী বানানো বা তার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য নয়, স্ত্রীর ন্যায়সঙ্গত সুযোগসুবিধা নিশ্চিতকরণ আর তার জীবনযাপনকে শরিয়তসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনার জন্য দেয়া হয়েছে।
তারপর সমাজের আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ‘ইহসান’ বজায় রাখার আদেশ করা হয়েছে। ইহসান মানে পারস্পরিক অনুগ্রহ, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, কল্যাণকামিতা, ক্ষমাপরায়ণতা, সহযোগিতা, আমানতদারিতা, ইনসাফ। এসব চর্চার মাধ্যমে সমাজ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে, পোক্ত বন্ধনে অটুট থাকবে। সলাতের বিস্তারিত অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সলাত দ্বীনের স্তম্ভবিশেষ। কোনও অবস্থাতেই সলাত আদায়ে ছাড় নেই। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও।
কোনও ভূমিতে দ্বীন ও ঈমান নিয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকলে, সেখান থেকে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা জরুরি। উম্মাহর অস্তিত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিসৃষ্টিকারী বহিঃশত্রুর কথা বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। উম্মাহর শরীর বেয়ে ওঠা এক নিকৃষ্ট আগাছা ও ভয়ংকর জীবাণু (মুনাফিক) সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত, কূটকৌশলের ব্যাপারে সচেতন থাকা কাম্য। আহলে কিতাব, বিশেষ করে ইহুদিদের দিক থেকে আসা ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। নবি-রাসুলের প্রতি ইহুদিদের ঘৃন্য আচরণের কথা বলা হয়েছে। মাসিহ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খ্রিস্টানরা ভ্রষ্টতায় নিপতিত। তাদেরকে আকিদায়ে তাওহিদের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূরাতুল মায়িদা!
মূলবক্তব্য: ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন। শরিয়ত ও হুদুদ-কিসাস বাস্তবায়নে যতœবান হওয়া। দ্বীনের পূর্ণতাদান। এই সুরাকে কুরআনের পূর্ণাঙ্গতম সুরা বলে বিবেচনা করা হয়। শরিয়তের শাখাগত বিভিন্ন বিধান বর্ণিত হয়েছে এই সুরায়। হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ বর্ণিত হয়েছে।
শরিয়ত ও দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাসুলগণের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা আছে। অন্যান্য উম্মতের ব্যাপারে গৃহিত প্রতিশ্রুতির কথা আছে। এর মাধ্যমে দ্বীন পূর্ণতা পেয়েছে। মায়েদা পূর্ণতাজ্ঞাপক সুরা।
ক. এহরাম অবস্থায় শিকার হারাম করা হয়েছে। এটা এহরামের পূর্ণতার পরিচায়ক।
খ. মদ হারাম করা হয়েছে। এটা আকল ও দ্বীন হেফাজতের পূর্ণাঙ্গতার পরিচায়ক।
গ. সীমালঙ্ঘনকারী চোর ও হানাদারদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এটা রক্ত ও সম্পদ সংরক্ষণের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক।
ঘ. তইয়িবাত বা উত্তম বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে। এটা আল্লাহর ইবাদত পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পরিচায়ক।
শরিয়তে মুহাম্মাদির একান্ত নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যবাহি কিছু বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ওজু ও তায়াম্মুমের কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত সমস্ত ধর্মমতের ওপর কুরআনি শাসনের কথা বলা হয়েছে। এসব কারণে সুরা মায়েদায় ‘ইকমাল ও ইতমাম’ শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
কেউ ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে, আল্লাহ তার চেয়েও উত্তম কাউকে দিয়ে ইসলামকে সমৃদ্ধ করবেন। এই দ্বীন কেয়ামত পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ থাকবে। আকিদা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আহলে কিতাবের কাসাস বর্ণিত হয়েছে। অঙ্গীকার-চুক্তি বিষয়ক বিধান বর্ণিত হয়েছে। জবেহ, শিকার, এহরাম, কিতাবি নারীকে বিয়ে, রিদ্দাহ, পবিত্রতার বিধান, চুরি, সীমালঙ্ঘন ও পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির হদ বর্ণিত হয়েছে। মদ-জুয়া, পশুবলি, ভাগ্যনির্ধারণী তীর, কসমের কাফফারা, আল্লাহর শরিয়তকে বিধানরূপে গ্রহণ করা, মৃত্যুর সময় ওসিয়তসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ের বিধান বর্ণিত হয়েছে।
বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময় সংঘটিত মুসা ও বনি ইসরায়েলের কিসসা বলা হয়েছে। বনি ইসরায়েল নবির হুকুম মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুসা আ. তাদেরকে ত্যাগ করেছিলেন। আদম আ.-এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিলের কিসসা আছে। এ দুজনের ঘটনা দুই প্রকার মানুষের নমুনা,
ক. পাপী দুষ্ট মানুষের নমুনা।
খ. মহৎ উত্তম মানুষের নমুনা।
হাবিল হত্যা ছিল পৃথিবীর প্রথম নিষ্পাপ ব্যক্তির রক্তপাত। মায়েদার কিসসা বলা হয়েছে। এটা ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের মুজিযা। আহলে কিতাবের ভ্রান্ত আকিদার আলোচনা আছে। তারা অঙ্গীকার-চুক্ত ভঙ্গ করেছিল। তারা তাওরাত-ইনজিল বিকৃত করে ফেলেছিল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানতে অস্বীকার করেছিল। তাদের আরো নানা কুফরি ও গোমরাহি ছিল।
শেষে হাশরের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন মাসিহ আলাইহিস সালামকে সবার সামনে ডাকা হবে। নাসারাদের লাঞ্ছিত করার জন্য ঈসাকে প্রশ্ন করা হবে। খ্রিস্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যিশুর পূজা করে। সেদিন আল্লাহর শত্রুদের অবস্থা শোচনীয় হবে। ভয়ে মাথার চুল শাদা হয়ে যাবে। তীব্র আতঙ্কে হৃদয় ফেটে পড়ার উপক্রম হবে।
সূরাতুল আনআম!
মূলবক্তব্য: কাফেরদের ভ্রান্ত আকিদার মুখোশ উন্মোচন করে তাদের বিরুদ্ধে হুজ্জত কায়েম করা হয়েছে। সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের সাহায্যে সহিহ আকিদা বর্ণনা করা হয়েছে। এটাই মুশরিক, বেদাতি, পরকাল অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিতর্কের কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য আকিদাগুলো একসাথে সামষ্টিকভাবে নাযিল হওয়া প্রয়োজন ছিল। এই সুরা দ্বীনের হাকিকত, শরিয়তের মূলনির্যাস, তাওহিদের মূলনীতিকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে। দ্বীনের সহায়ক শক্তিকে দৃঢ় সমর্থন যুগিয়েছে। দ্বীনবিরোধীদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। ভ্রান্ত বিশ^াসী, নাস্তিকদের রদ করেছে। এক্ষেত্রে নানাবিধ বিস্ময়কর পদ্ধতিতে মুনাজারা-মুজাদালা করা হয়েছে। সুরাতুল আনআমকে জাহেলি যুগে আরবের রীতিনীতি বর্ণনার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতম সুরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুরা আনআমে জাহেলি রীতিনীতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আরবদের নানা নির্বুদ্ধিতামূলক আকিদাকে তুলোধুনা করা হয়েছে। ঈমান-আকিদার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে,
ক. তাওহিদ। মুনাজারা-মুজাদালা ও প্রশ্নের উত্তর দানের পদ্ধতিতে আকিদার মৌলিক মূলনীতি বর্ণনা। আল্লাহর অস্তিত্ব, এককত্ব, আল্লাহর সিফাত, মানুষ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর আয়াতসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।
খ. ওহি ও রেসালত প্রমাণ করা হয়েছে। রেসালত সম্পর্কিত সন্দেহ দূর করা হয়েছে।
গ. পুনরুত্থান, পুনর্জীবন, কেয়ামত দিবসে হিসাবের কথা বলা হয়েছে।
পরিশেষে টেন কমান্ডমে-স বা দশ অমূল্য নসিহত পেশ করা হয়েছে। এই উপদেশগুলো পূর্ববতী সমস্ত আসমানি কিতাবে বিদ্যমান ছিল। সমস্ত নবি-রাসুল এই দশ উপদেশের দাওয়াত দিয়ে গেছেন।
সূরাতুল আরাফ!
মূলবক্তব্য: মানবতা শুরু থেকে আখেরাতে ফেরা পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমায় আকিদায়ে তাওহিদ ফুটিয়ে তোলা।
শুরুতে কুরআনের আলোচনা। সমগ্র মানবতার ওপর কুরআন রহমানের নেয়ামত। একপিতা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করে সম্মানিত করাও একটি নেয়ামত। হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বের নমুনাস্বরূপ আদম ও ইবলিসের কিসসা বলা হয়েছে। কেয়ামতের বর্ণনায় তিনটি দলের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে: মুমিন, কাফের ও আরাফে অবস্থানকারী দলের দৃশ্য। কেয়ামতদিবসে সবাই এই তিনদলের দৃশ্য অবলোকন করবে। সেদিন জান্নাতবাসীরা জাহান্নামীদের নিয়ে হাসিমস্করা করবে। এক বিকট আওয়াজ পাপীদের জন্য বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা ডেকে আনবে। জান্নাতি ও আরাফিদের মাঝে পর্দা ফেলে অন্তরায় সৃষ্টি করা হবে। আরাফের ওপর একদল লোক দাঁড়ানো থাকবে। তারা চিহ্ন দেখে অন্যদের চিনতে পারবে। চেহারার শুভ্রতা ও সজিবতা দেখে জান্নাতিদের চিনবে। চেহারার কালিমা ও মলিনতা দেখে জাহান্নামিদের চিনবে।
বিস্তারিতভাবে নবিগণের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ, হুদ, সালেহ, লুত, শোয়াইব ও মুসা আলাইহিমুস সালাম। বনি ইসরায়েলের ওপর নেমে আসা দুঃখ-দুর্দশার কথা বলা হয়েছে। তারপর তারা শান্তিময় জীবন ও প্রাচুর্যময় জীবনের দেখা পেয়েছিল। একসময় বনি ইসরায়েল আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে শুরু করেছিল। শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে ঘৃণিত বানর ও শুকরে পরিণত করেছিলেন। ওলামায়ে সুয়ের লাঞ্ছনার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। ওলামায়ে সু বা মন্দ আলেমের ঘৃণিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাকে তুলনা করা হয়েছে জিভ বের করে একটানা হাঁপাতে থাকা কুকুরের সাথে। কুকুর সবসময় মাটিকাঁদা ঘেঁটে খায়। এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত আর হতে পারে না। আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, ওলামায়ে সু সে ইলম ব্যবহার করে দুনিয়ার খুদকুঁড়ো পাওয়ার পেছনে। শেষে তাওহিদের কথা বলা হয়েছে। লাভক্ষতি করতে না পারা উপাস্য, মাটিপাথর পূজো করা ব্যক্তিদের প্রতি বিদ্রƒপ করা হয়েছে। তারা এসবকে আল্লাহর শরিক বানিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এক। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষের বিচরণস্থল ও পরিণতিস্থল জানেন।
সূরাতুল আনফাল!
মূলবক্তব্য: বান্দার নিজস্ব কোনো শক্তি-সামর্থ নেই। মানুষকে আল্লাহর আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। বিশ^াস করতে বলা হয়েছে, তার কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ সম্পূর্ণই সহায়-সম্বলহীন। এই বিশ^াস থেকেই মানুষ আল্লাহর আদেশ আঁকড়ে ধরবে। ফলে তাদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি হবে, দ্বীনের বিজয় হবে, ফাসাদকারীরা অপদস্থ হবে। শরিয়তের বেশ কিছু ‘মাকাসেদ’, কিতাল ও গনিমত সম্পর্কিত বিধান, শরিয়তের মূলনীতি, সৃষ্টি ও জগত পরিচালনা নীতি, ঐক্যের মূলনীতি, সাধারণ ও বিশেষ বন্ধুত্ব, চুক্তি-অঙ্গীকার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, নফস ও উত্তম আদব-আখলাক সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। বিজয় সম্পর্কি যাবতীয় মূলনীতি, বিজয়ের মূল্যবোধ ও বিজয়ের জন্য বস্তুগত উপকরণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
বিজয়ের পরবর্তী সময়ে অহংকার ও শয়তানের প্ররোচনার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। সুরাটি বদরের পরপর নাযিল হয়েছে। বদর ছিল হক ও বাতিলের প্রথম মুখোমুখি লড়াই। অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। বদরের মাধ্যমেই বাতিল শক্তি টের পেয়েছে, তাদের শক্তি যতই প্রবল হোক, তাদের দাপট যতই দীর্ঘায়িত হোক, তাদের প্রভুত্ব-আধিপত্য যতই প্রসারিত হোক, তাদের কীর্তি-গীতি যতই উঁচু হোক, অবশ্যই একদিন হক ও ঈমানি শক্তির সামনে মাথা নোয়াতে হবেই। বদর ছিল ইসলামের ইতিহাসে অনাগত হাজারো বিজয়ের সোপান। বদর আল্লাহর সৈনিকদের বিজয়ের সূচনা। সাহাবায়ে কেরাম এই আনফালকে ‘সুরা বদর’ বলতেন। কারণ এই সুরায় বদরের কথা বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। বদরের বিস্তারিত যুদ্ধপরিকল্পনা এই সুরায় বর্ণিত হয়েছে। বাতিলের সামনে মুমিনকে কেমন সাহসিকতা, আস্পর্ধা ও দৃঢ়তা-অবিচলতা-সংকল্পের সাথে রুখে দাঁড়াতে হবে, কেমন বীরত্ব আর কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে হবে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। ময়দান ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ ও রাসুলের পরিপূর্ণ আনুগত্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসুল যেদিকে দাওয়াত দেন, সেটা মুমিনদের জন্য উভয় জাহানে জীবন, সৌভাগ্য, সম্মান বয়ে আনবে। দ্বীন হল হায়াত ও নুর। কুফর হল মওত ও অন্ধকার। ইজ্জত-সম্মানের পথ ও বিজয়ের ভিত স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। শত্রুর সামনে অবিচল থাকা, যুদ্ধের সময় সবর করাই বিজয়ের মূলকথা। এক্ষেত্রে আল্লাহর অপরিমেয় বড়ত্ব, অপরাজেয় শক্তির কথা মাথায় রাখা কর্তব্য। এটা মুমিনকে আত্মিক শক্তি যোগাবে। এই শক্তি বিজয়ের পথে প্রধানতম সহায়ক। আত্মিক শক্তি অর্জিত হয় বেশি বেশি জিকিরের মাধ্যমে। মুমিনদের মাঝে পরিপূর্ণ বন্ধুত্বের কথা বলা হয়েছে। দূরত্ব যতই হোক, জাতিগোত্রে যতই বৈপরীত্ব থাকুক সবাই এক উম্মাহ।
সূরাতুত তাওবা!
মূলবক্তব্য: বিভিন্ন দলের প্রকৃত অবস্থা ফাঁস করা হয়েছে। কাফেরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, মুনাফিকের মুখোশ উন্মোচন, মুমিনদেরকে অন্যদের থেকে পৃথককরণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বিধান, জিহাদের মাকাসেদ ও ফাজায়েল, জিহাদকারী দল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। শিথিলতা করে জিহাদে না গিয়ে পিছিয়ে থাকা মুনাফিকক ও তাদের মতো লোকদের কথা বলা হয়েছে। মুমিন, কাফের ও মুনাফিক সবার জন্য তাওবার দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। সুরায় প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে,
ক. মুশরিক ও আহলে কিতাবের সাথে ইসলামি শরিয়ার বিধান।
খ. গযওয়া তাবুকে রোমকদের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলে, কার মনে কী আছে, সেটা প্রকাশ করা।
মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করা ‘ফিফথ কলাম’ (মুনাফিক) সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানের জন্য মুনাফিকরা মুশরিকের চেয়েও বেশি বিপদজনক। তাদের মুনাফিকির পদ্ধতি, তাদের নানা ফন্দিফিকির ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। মুমিনদের মাধ্যমে তাদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। তাদের কোনো কিছুই গোপন রাখা হয়নি। সবই উন্মোচিত করে দেয়া হয়েছে। তাদের অন্তরের গোপন কথাও প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকদের আলামত বলে দেয়া হয়েছে। এই সুরা নাযিলের পর মুমিনগণ সহজেই তাদের সাথে বাস করা মুনাফিকদের চিনে ফেলতে পারতেন। মুনাফিকরা অনবরত ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত। তারা ইসলাম ধ্বংস ও মুসলমানদের ক্ষতির উদ্দেশ্যে মসজিদের নাম দিয়ে ষড়যন্ত্রখানা খুলেছিল। সেখানে বসে বসে তারা মুসলিম সমাজে ফাটল ধরানোর চক্রান্তে লিপ্ত থাকত। সেটাকে কুরআনে মসজিদে দিরার নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল ও সাহাবীগণ অভিযান চালিয়ে সে মসজিদকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তাদের চক্রান্ত, কূটকৌশল, অনিষ্ট, হীনপ্রয়াস থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য একমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। কেয়ামত দিবস পর্যন্ত আগত মুনাফিকের পরিচয় দিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই সুরায় সবচেয়ে বেশি ‘তাওবা’ ও এই শব্দমূল থেকে নির্গত শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭ বার নানা আঙ্গিকে তাওবার কথা আছে। অথচ এই সুরায় প্রধানত মুনাফিক ও মুশরিকদের কথাই বেশি বলা হয়েছে। আসলে বারবার তাওবার কথা বলে, সবার প্রতি তাওবার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাওবা ছাড়া কারো মুক্তি নেই। সুরায় কঠোর ভাষা, হুমকিধমকি ও তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী ভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে। যদি তারা তাওবা করতে চায়, তাহলে তাদেরকে প্রথমে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনতে হবে। ঈমানের পূর্বশর্ত পালন করতে হবে। ইসলাম গ্রহণ পূর্বের সমস্ত পাপ ধুয়েমুছে দেয়।
সূরাতু ইউনুস!
মূলবক্তব্য: ওহি অস্বীকারকারীদের সামনে যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন। তাদেরকে তরগিব ও তরহিবের মাধ্যমে ঈমানের দাওয়াত। ঈমানের মূলনীতি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান ও অন্যান্য রোকন যথা, আসমানি কিতাবের প্রতি ঈমান আনা, বিশেষ করে কুরআনের প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। পুরো সুরাতে আকিদা বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। আলোচনার ঐক্যের কারণে পুরো সুরাকে একটি অখ- গোশতপি-ের মতোই মনে হবে।
শুরুতে রেসালত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রেসালত ও কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন ও প্রজ্ঞাময় পরাক্রমশালী আল্লাহর কর্মব্যবস্থাপনার পরিচয়বাহী রহমত বর্ণনার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর সিফাতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু নবির কাসাস বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ ও তার কওম, মুসা ও ফেরাওন, ইউনুস আলাইহিমুস সালামের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব কিসসা বলার উদ্দেশ্য, মুমিনদেরকে সাহায্য করা ও জালেমদের ধ্বংস করায় আল্লাহর কর্মনীতি বর্ণনা। রাসুলকে আল্লাহর শরিয়ত আঁকড়ে ধরার হুকুম দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করতে গিয়ে সম্মুখিন হওয়া কষ্টযন্ত্রণায় সবর করার হুকুম দেয়া হয়েছে।
সূরাতু হুদ!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর উলুহিয়ত বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। মুমিনদের কলবে আকিদাকে পোক্ত করে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য এই সুরায় রাসুলগণ ও তাদের কওমের মাঝে কথোপকথন বেশ কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কথোপকথনের মাধ্যমেই আকিদা দুরুস্ত করার কাজ করা হয়েছে।
শুরুতেই কুরআনের কথা। এই কিতাবের আয়াতসমূহকে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। আয়াতসমূহের মাঝে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি, বৈপরীত্ব নেই। কারন এই কুরআন প্রজ্ঞাময় পরাক্রমশালীর তরফ থেকে নাযিল হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত¡না দেয়ার উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ নবি-রাসুলের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ ও তুফানের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। হুদের কথা বলা হয়েছে। তার নামে সুরার নামকরণ করে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়ে গিয়ে করা তাঁর মেহনত-মুজাহাদাকে অমর করে রাখা হয়েছে। সালেহ, লুত, শোয়াইব, মুসা ও হারুন আলাইহিমুস সালামের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর নবিগণের কিসসায় জালেমদের ধ্বংসকরণে যেসব শিক্ষা ও নসিহত আছে, সেটা ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব কিসসায় হেদায়াতপ্রাপ্ত ও গোমরাহ দলের কর্মগত তুলনা ফুটে উঠেছে। নিশ্চিত করা হয়েছে, হেদায়াতের পরিণতি ‘নাজাত’, গোমরাহির পরিণতি ধ্বংস। নাজাত বা মুক্তি কারণগুলোও বর্ণনা করা হয়েছে: আল্লাহর আদেশের ওপর অটল অবিচল থাকা, আল্লাহর আদেশ অমান্য না করা, জালেমদের দলে না ভেড়া, দিনের দুই প্রান্তে ও রাতের অংশে সলাত কায়েম করা, আল্লাহর রাস্তায় নিজের ওপর নেমে আসা কষ্টে সবর করা।
রাসুলগুণের কিসসা বর্ণনার হেকমত বলা হয়েছে: আগের যুগে মিথ্যাচারী সম্প্রদায়ের ওপর যা ঘটেছে, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, কষ্ট-যন্ত্রণায় জর্জরিত নবিজির কলবকে সুদৃঢ় করা। এই সুরায় দাওয়াতে তাওহিদের দায়ীদের জন্য একটি বার্তা আছে: তোমরা যে কাজে আছো, তাতে অবিচল থাকো। কারণ চুড়ান্ত পরিণতিতে, আখেরাতের আগে দুনিয়াতেই তোমাদের জন্য উত্তম পুরস্কার আছে। তোমরা শত বিপদাপদ, হাজারো দুঃখকষ্ট, অসংখ্য মনখারাপ করা ঘটনা, অগণিত দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও তোমরা আল্লাহর তত্ত্বাবধানে আছো।
সূরাতু ইউসুফ!
মূলবক্তব্য: নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কে আশ^াস ও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে: দুঃখকষ্ট (ইবতিলার) পর তামকিন-প্রতিষ্ঠা দেয়া হবে।
পুরো সুরায় ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিসসা বর্ণিত হয়েছে। তিনি ভাই ও মিসরে আজিজের ঘরে অন্যদের থেকে, কারাগারে, নারীদের ষড়যন্ত্রে অনেক দুঃখকষ্ট, যন্ত্রণা-যাতনা সহ্য করেছেন। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি দান করেছেন। আল্লাহর রাস্তায় আসা বিপদাপদে সবরের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে কারাগার থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দিয়েছেন। মিসরের আজিজ বানিয়ে দিয়েছেন। জমিনের ঐশ^র্যের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সবার প্রিয়, সর্বজনমান্য নেতা। মিসরভূমিতে সম্মানিত আজিজ। তার কিসসা আসন্ন বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে নাযিল হয়েছিল। যারা সবর করবে, নবিরাসুলের পথ অবলম্বন করবে, মুখলিস দায়ীগণের আদর্শ ধারণ করবে, এই সুরা তাদের জন্য পরম সান্ত¡নার কাজ করবে, বিপদে আশার বাণী শোনাবে। এই কিসসায় আছে শিক্ষা ও উপদেশ, ওয়াজ-নসিহত। আছে কুরায়শের নির্যাতনে জর্জরিত নবিজি ও মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরম সান্ত¡না।
আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত আস্থা, আল্লাহর প্রতি ভরসাবিশ^াস বান্দাকে আল্লাহর সব ধরণের ফয়সালা ও বিপদে আশাবাদী অবস্থায় সবর করতে সহায়তা করে। মুমিন দৃঢ়বিশ^াস রাখে, জুলুম-নির্যাতন যতই দীর্ঘ হোক, একদিন সুরাহা আসবেই। ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিসসাকে কুরআনের সুন্দরতম কিসসা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ,
১. হিংসুক ও হিংসার শিকার ব্যক্তির কথা আছে।
২. মালিক ও মামলুক (মালিকানাধীন ব্যক্তিবস্তুর) কথা আছে।
৩. সাক্ষী ও অভিযুক্তের কথা আছে।
৪. আশেক ও মাশুকের কথা আছে।
৫. আটক হওয়ার পর নিষ্কৃতির কথা আছে।
৬. কারাবাসের পর কারামুক্তির প্রসঙ্গ আছে।
৭. শুষ্কতা ও উষরতার পর উর্বরতা, সজিবতার কথা আছে।
৮. সংকটের পর উত্তরণের কথা আছে।
৯. দুর্যোগের পর সুযোগের কথা আছে।
১০. বঞ্চনার পর প্রাপ্তির কথা আছে।
১১. লাঞ্ছনার পার সম্মানের কথা আছে।
১২. বিচ্ছেদের পর মিলনের কথা আছে।
১৩. দুঃখশোকের পর আনন্দের কথা আছে।
এজন্য বলা হয়, কোনো শোকগ্রস্ত ব্যক্তি এই সুরা বুঝে বুঝে পড়লে, তার মনের ভার কেটে যাবেই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন