একনজরে
কুরআন কারিম
আতিক উল্লাহ
একনজরে কুরআন কারিম: ১
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
----
সূরাতুল ফাতিহা
কুরআন কারীমের সবচেয়ে অর্থবহ সুরা। সুরাটি আয়াতের স্বল্পতা আর আকারে হ্রস্ব হওয়া সত্বেও, সংক্ষেপে পুরো কুরআন তো বটেই, সমস্ত আসমানি কিতাবেরও সারনির্যাস ধারণ করে আছে। এই সুরায় আছে- দ্বীনের মৌলিক নীতিমালা ও শাখাগত বিষয়াবলী, শরীয়তের বিধান, শেষদিনের প্রতি ঈমান, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, একমাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া ও দোয়া করা, আল্লাহর দিকে অভিমুখী হয়ে আল্লাহর কাছে সত্যদ্বীনের হেদায়াত-পথনির্দেশ ও সিরাতে মুস্তাকিম-সরলপথ প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে কাকুতিমিনতি করে ঈমান ও সালেহিনের অনুসৃত পথের ওপর অটল থাকাও দোয়ার প্রসঙ্গ। গযবগ্রস্ত ও পথভ্রষ্টদের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার দোয়াও আছে। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের কিসসা আছে। সৌভাগ্যবানদের উচ্চমর্যাদা ও দুর্ভাগাদের অধঃপতিত স্তর বর্ণিত হয়েছে। সুরা ফাতিহায় আছে শরীর ও হৃদয়ের আরোগ্য।
তাওহিদে রুবুবিয়ত, তাওহিদে উলুহিয়ত, তাওহিদে আসমা ও সিফাতের প্রসঙ্গ আছে। নবুয়তের সত্যতার প্রমাণ আছে। শেষবিচারে কর্মফলের কথা আছে। তাকদিরের কথা আছে। যাবতীয় বেদাতি ও গোমরাহ দলের প্রতি রদ আছে। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের প্রতি অনুগত্যের আদেশ আছে। আল্লাহর ইবাদতের পদ্ধতি বলা হয়েছে। সৃষ্টির ওপর ¯্রষ্টার হকের বর্ণনা আছে। ¯্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির প্রয়োজন ও মুখাপেক্ষিতার কথা আছে। ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিন্যাস আছে। এই সম্পর্কের সূচনায় রহমত, মাঝে হেদায়াত, শেষধাপে থাকে নেয়ামত। পুরো কুরআনে যা কিছু আছে, সবই সুরা ফাতিহার তাফসির। সুরা ফাতিহা অন্য সব সুরার মায়ের মতো। এজন্য ফাতিহাকে উম্মুল কিতাব বলা হয়। কারণ এই সুরায় পুরো কুরআনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণিত হয়েছে। অন্য কোনো সুরা ফাতিহার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার মতো নয়। অন্য কোনো সুরা এই সুরার শূন্যতা পূরণ করার মতোও নয়। তাওরাত ও ইনজিলে এই সুরার মতো সমতুল্য কিছু নাযিল হয়নি।
আল্লাহ তাআলা বহু কিতাব নাযিল করেছেন। সব কিতাবের বক্তব্য যাবুর, তাওরাত ও ইনজিল এই তিন কিতাবে সমাহার ঘটিয়েছেন। এই তিন কিতাবের নির্যাস কুরআনে জমা করেছেন। কুরআনের নির্যাস সুরা ফাতিহায় জমা করেছেন। সুরা ফাতিহাকে জমা করেছেন,
আমরা আপনারই ইবাদত করি, আপনার কাছেই সাহায্য চাই (৪)।
সুরাতুল বাকারা!
কুরআনের সবচেয়ে দীর্ঘ সুরা। এই সুরায় একহাজার আদেশ, একহাজার নিষেধ, একহাজার হুকুম, একহাজার খবর-সংবাদ আছে। পৃথিবীতে আল্লাহর খিলাফাহ বা প্রতিনিধিত্বকে ঘিরেই পুরো সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। কারা যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করেছেন, কারা করেনি-এই দুই শ্রেণিই মূলত সুরার প্রধান চরিত্র।
শরিয়তের মূলনীতি বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। দুনিয়া ও আখেরাতের নিয়মকানুন বর্ণিত হয়েছে। মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সামাজিক, রাষ্ট্রিক, পারিবারিক জীবনের বিধিবিধান আলোচিত হয়েছে। ইলমের মূলনীতি, দ্বীনের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। কুরআন কারীমের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন আয়াত ‘আয়াতুল কুরসি’, কুরআন কারীমের সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াত ‘আয়াতুদ দাইন’ বা ঋণের আয়াত এই আছে। ইসলামি আকিদা, ইবাদত, মুআমালা, আখলাক, নিকাহ, তালাক, দুগ্ধপান করানো, ইদ্দতসহ শরিয়তি বিধান বিষয়ক বেশিরভাগ আয়াত এই সুরায় উল্লেখিত হয়েছে। পুরো সুরার আলোচ্যবিষয়কে ছয়টি মূলধারায় প্রকাশ করা যেতে পারে,
১: কুরআনের সত্যতার কথা বলা হয়েছে। কুরআনের দাওয়াত সত্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. কুরআনি হেদায়াত গ্রহন ও বর্জনের দিক থেকে মানুষ তিন প্রকার: মুমিন, কাফের, মুনাফিক। ঈমান, কুফর ও নিফাকের হাকিকত বর্ণিত হয়েছে।
৩. আদম আ.-এর কিসসার মধ্য দিয়ে মানুষের সৃষ্টির গোড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। সৃষ্টির সূচনায় আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনের যেসব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল, তার বর্ণনা আছে।
৪. আহলে কিতাব সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে। বিশেষ করে ইহুদিদের সম্পর্কে। কারণ মদিনায় তারাই মুসলমানদের প্রতিবেশি ছিল। ইহুদিদের আকিদাবিশ^াস নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষদের ওপর আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে ইহুদিদের ধোঁকা-প্রবঞ্চনা সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ইহুদিদের অন্তর্গত স্বভাবজাত নিচুতা, গাদ্দারি, বিশ^াসঘাতকতা, ওয়াদাচুক্তি-অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রবণতার কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে। ইহুদিদের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, একথা বোঝানো হয়েছে।
৫. সুরার দ্বিতীয়ার্ধে শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণিত হয়েছে। মদিনায় হিজরতের পর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মেহনত শুরু হয়েছিল। এসময় আইনকানুন জানার প্রয়োজন ছিল তীব্র। চাহিদার প্রেক্ষিতেই নাযিল করা হয়েছিল-কিসাস, সিয়াম, হজ-ওমরা, জিহাদ, নিকাহ, তালাক, ইদ্দত রেজাআত, যাকাত-সদকা, বেচাকেনা, সুদের বিধান।
৬. সুরার শেষে মুমিনদেরকে আল্লাহর কাছে তাওবা-ইনাবতের তাগিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কাছে কাকুতিমিনতি করে কান্নাকাটি করতে বলা হয়েছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে সাহায্য চাইতে বলা হয়েছে।
সূরাতু আলে ইমরান!
পুরো সুরার আলোচনা আল্লাহর ওয়াহদানিয়ত বা এককত্বকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এ বিষয়ে আকলি ও নকলি দলিল পেশ করা হয়েছে। মোটাদাগে দ্বীনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ আর মৌলিক রোকন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে,
১: আকিদা বিষয়ক আলোচনা। আল্লাহর এককত্বের ওপর দলিল-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
২. শরিয়তের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। বিশেষ করে মাগাজি-জিহাদ বিষয়ক বিধান।
প্রথম বিষয়: আল্লাহর এককত্ব, নবিগণের নবুয়ত, কুরআনের সত্যতা বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলাম, কুরআন ও মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে আহলে কিতাবের উত্থাপিত অভিযোগের জবাব দেয়া হয়েছে। ঈসা মাসিহ সম্পর্কে খ্রিস্টানদের বিতর্ক তুলে ধরা হয়েছে। তারা ঈসাকে ইলাহ মনে করত। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে অস্বীকার করত। সুস্পষ্ট দলিল ও অকাট্য দলিল দিয়ে তাদের ভ্রান্ত চিন্তা রদ করা হয়েছে। এসবের ফাঁকে ফাঁকে ইশারায় ইহুদিদের নিন্দা করা হয়েছে। মুসলমানদেরকে আহলে কিতাবের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিষয়: শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণনা করা হয়েছে। হজ ফরজ হওয়া, জিহাদ, সুদ হারাম হওয়া, যাকাত প্রদানে অনীহ ব্যক্তির বিধান আলোচিত হয়েছে। গযওয়া বদর ও ওহুদের আলোচনা আছে। এসব যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। সঠিক আকিদা ও মানহাজের ওপর অবিচল থাকার উপায় বলা হয়েছে। তাওহিদ ও আল্লাহর কাছে দোয়া-রোনাজারির মাধ্যমেই এটা সম্ভব। জিহাদের ময়দানে অবিচল থাকার উপায় বলা হয়েছে। আল্লাহ ও রাসুলের অনুগত্য, দুনিয়ার সাথে জড়িয়ে না পড়া, আল্লাহর রজ্জু আঁকড়ে ধরা ও বিভক্ত না হওয়ার মাধ্যমে এটা সম্ভব।
সুরার শেষে কিছু বিষয় নিয়ে তাদাব্বুর করতে বলা হয়েছে। আসমান, জমিন ও এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে, তা নিয়ে তাদাব্বুর করতে বলা হয়েছে। আসমান-জমিন সৃষ্টিতে আল্লাহর শিল্পনৈপুণ্য, অপূর্ব কৃতকৌশল, বিস্ময়কর গঠনশৈলী, অজানা রহস্য নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। আসমান-জমিনের এমন নিখুঁত সৃষ্টি একজন পরাক্রমশালী ¯্রষ্টার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। জিহাদ ও মুজাহিদিনের কথা বলা হয়েছে। এক পরিপূর্ণ সারগর্ভ উপদেশ দেয়া হয়েছে। এটা মেনে চলতে পারলে, সার্বিক কল্যাণ লাভ হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবে। পূর্ণতম সাফল্য লাভ হবে,
ٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اصْبِرُوْا وَصَابِرُوْا وَرَابِطُوْا ۟ وَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ
আলে ইমরান: ২০০
সুরাতুন নিসা
মূলবক্তব্য: সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সংরক্ষণ, জাহেলি যুগের রীতিনীতি দূরীকরণ, নারী ও দুর্বলের অধিকার সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে, মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকে বিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল করা।
নারী, ঘর, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। তবে, এই সুরায় বেশিরভাগ আলোচনা নারীকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এজন্য সুরার নামকরণও নারীর নামে হয়েছে। শুরুতে নারী, এতিম ও মিরাসের আলোচনা। বংশ, দুধপান ও বিয়ের সূত্রে হারাম হয়ে যাওয়া নারীগণ। দাম্পত্য সম্পর্ককে বিন্যস্ত করা হয়েছে। এটা শুধু স্বামী-স্ত্রীর শারীরিক সম্পর্কে সীমাবদ্ধ নয়, এটি আত্মিক ও মানবিক সম্পর্কও বটে। মোহর নিছক মজুরি বা প্রতিদান নয়, এটি ভালোবাসা বর্ধক উপহার। মোহর আদায়ের মাধ্যমে দুজনের সহাবস্থান সুন্দর, সুখকর হয়, আত্মিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
স্ত্রীর ওপর স্বামীর, স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকের কথা বলা হয়েছে। স্বামী তার স্ত্রীর ওপর কাউয়াম-তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। এই তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব স্ত্রীকে দাসী বানানো বা তার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য নয়, স্ত্রীর ন্যায়সঙ্গত সুযোগসুবিধা নিশ্চিতকরণ আর তার জীবনযাপনকে শরিয়তসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনার জন্য দেয়া হয়েছে।
তারপর সমাজের আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে ‘ইহসান’ বজায় রাখার আদেশ করা হয়েছে। ইহসান মানে পারস্পরিক অনুগ্রহ, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, কল্যাণকামিতা, ক্ষমাপরায়ণতা, সহযোগিতা, আমানতদারিতা, ইনসাফ। এসব চর্চার মাধ্যমে সমাজ শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াবে, পোক্ত বন্ধনে অটুট থাকবে। সলাতের বিস্তারিত অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। সলাত দ্বীনের স্তম্ভবিশেষ। কোনও অবস্থাতেই সলাত আদায়ে ছাড় নেই। এমনকি যুদ্ধের ময়দানেও।
কোনও ভূমিতে দ্বীন ও ঈমান নিয়ে দুর্বল অবস্থায় থাকলে, সেখান থেকে আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করা জরুরি। উম্মাহর অস্তিত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিসৃষ্টিকারী বহিঃশত্রুর কথা বলা হয়েছে। তাদের প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। উম্মাহর শরীর বেয়ে ওঠা এক নিকৃষ্ট আগাছা ও ভয়ংকর জীবাণু (মুনাফিক) সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের চক্রান্ত, কূটকৌশলের ব্যাপারে সচেতন থাকা কাম্য। আহলে কিতাব, বিশেষ করে ইহুদিদের দিক থেকে আসা ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। নবি-রাসুলের প্রতি ইহুদিদের ঘৃন্য আচরণের কথা বলা হয়েছে। মাসিহ আলাইহিস সালামের ব্যাপারে খ্রিস্টানরা ভ্রষ্টতায় নিপতিত। তাদেরকে আকিদায়ে তাওহিদের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সূরাতুল মায়িদা!
মূলবক্তব্য: ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি পালন। শরিয়ত ও হুদুদ-কিসাস বাস্তবায়নে যতœবান হওয়া। দ্বীনের পূর্ণতাদান। এই সুরাকে কুরআনের পূর্ণাঙ্গতম সুরা বলে বিবেচনা করা হয়। শরিয়তের শাখাগত বিভিন্ন বিধান বর্ণিত হয়েছে এই সুরায়। হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ বর্ণিত হয়েছে।
শরিয়ত ও দ্বীন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাসুলগণের প্রতিশ্রুতি পালনের কথা আছে। অন্যান্য উম্মতের ব্যাপারে গৃহিত প্রতিশ্রুতির কথা আছে। এর মাধ্যমে দ্বীন পূর্ণতা পেয়েছে। মায়েদা পূর্ণতাজ্ঞাপক সুরা।
ক. এহরাম অবস্থায় শিকার হারাম করা হয়েছে। এটা এহরামের পূর্ণতার পরিচায়ক।
খ. মদ হারাম করা হয়েছে। এটা আকল ও দ্বীন হেফাজতের পূর্ণাঙ্গতার পরিচায়ক।
গ. সীমালঙ্ঘনকারী চোর ও হানাদারদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এটা রক্ত ও সম্পদ সংরক্ষণের পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাপনার পরিচায়ক।
ঘ. তইয়িবাত বা উত্তম বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে। এটা আল্লাহর ইবাদত পূর্ণাঙ্গ হওয়ার পরিচায়ক।
শরিয়তে মুহাম্মাদির একান্ত নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যবাহি কিছু বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। ওজু ও তায়াম্মুমের কথা বলা হয়েছে। প্রচলিত সমস্ত ধর্মমতের ওপর কুরআনি শাসনের কথা বলা হয়েছে। এসব কারণে সুরা মায়েদায় ‘ইকমাল ও ইতমাম’ শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয়েছে।
কেউ ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে, আল্লাহ তার চেয়েও উত্তম কাউকে দিয়ে ইসলামকে সমৃদ্ধ করবেন। এই দ্বীন কেয়ামত পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ থাকবে। আকিদা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আহলে কিতাবের কাসাস বর্ণিত হয়েছে। অঙ্গীকার-চুক্তি বিষয়ক বিধান বর্ণিত হয়েছে। জবেহ, শিকার, এহরাম, কিতাবি নারীকে বিয়ে, রিদ্দাহ, পবিত্রতার বিধান, চুরি, সীমালঙ্ঘন ও পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির হদ বর্ণিত হয়েছে। মদ-জুয়া, পশুবলি, ভাগ্যনির্ধারণী তীর, কসমের কাফফারা, আল্লাহর শরিয়তকে বিধানরূপে গ্রহণ করা, মৃত্যুর সময় ওসিয়তসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ের বিধান বর্ণিত হয়েছে।
বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময় সংঘটিত মুসা ও বনি ইসরায়েলের কিসসা বলা হয়েছে। বনি ইসরায়েল নবির হুকুম মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। মুসা আ. তাদেরকে ত্যাগ করেছিলেন। আদম আ.-এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিলের কিসসা আছে। এ দুজনের ঘটনা দুই প্রকার মানুষের নমুনা,
ক. পাপী দুষ্ট মানুষের নমুনা।
খ. মহৎ উত্তম মানুষের নমুনা।
হাবিল হত্যা ছিল পৃথিবীর প্রথম নিষ্পাপ ব্যক্তির রক্তপাত। মায়েদার কিসসা বলা হয়েছে। এটা ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের মুজিযা। আহলে কিতাবের ভ্রান্ত আকিদার আলোচনা আছে। তারা অঙ্গীকার-চুক্ত ভঙ্গ করেছিল। তারা তাওরাত-ইনজিল বিকৃত করে ফেলেছিল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মানতে অস্বীকার করেছিল। তাদের আরো নানা কুফরি ও গোমরাহি ছিল।
শেষে হাশরের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন মাসিহ আলাইহিস সালামকে সবার সামনে ডাকা হবে। নাসারাদের লাঞ্ছিত করার জন্য ঈসাকে প্রশ্ন করা হবে। খ্রিস্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যিশুর পূজা করে। সেদিন আল্লাহর শত্রুদের অবস্থা শোচনীয় হবে। ভয়ে মাথার চুল শাদা হয়ে যাবে। তীব্র আতঙ্কে হৃদয় ফেটে পড়ার উপক্রম হবে।
সূরাতুল আনআম!
মূলবক্তব্য: কাফেরদের ভ্রান্ত আকিদার মুখোশ উন্মোচন করে তাদের বিরুদ্ধে হুজ্জত কায়েম করা হয়েছে। সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের সাহায্যে সহিহ আকিদা বর্ণনা করা হয়েছে। এটাই মুশরিক, বেদাতি, পরকাল অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিতর্কের কার্যকর পদ্ধতি। এজন্য আকিদাগুলো একসাথে সামষ্টিকভাবে নাযিল হওয়া প্রয়োজন ছিল। এই সুরা দ্বীনের হাকিকত, শরিয়তের মূলনির্যাস, তাওহিদের মূলনীতিকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেছে। দ্বীনের সহায়ক শক্তিকে দৃঢ় সমর্থন যুগিয়েছে। দ্বীনবিরোধীদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। ভ্রান্ত বিশ^াসী, নাস্তিকদের রদ করেছে। এক্ষেত্রে নানাবিধ বিস্ময়কর পদ্ধতিতে মুনাজারা-মুজাদালা করা হয়েছে। সুরাতুল আনআমকে জাহেলি যুগে আরবের রীতিনীতি বর্ণনার ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গতম সুরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুরা আনআমে জাহেলি রীতিনীতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আরবদের নানা নির্বুদ্ধিতামূলক আকিদাকে তুলোধুনা করা হয়েছে। ঈমান-আকিদার মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে,
ক. তাওহিদ। মুনাজারা-মুজাদালা ও প্রশ্নের উত্তর দানের পদ্ধতিতে আকিদার মৌলিক মূলনীতি বর্ণনা। আল্লাহর অস্তিত্ব, এককত্ব, আল্লাহর সিফাত, মানুষ ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর আয়াতসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।
খ. ওহি ও রেসালত প্রমাণ করা হয়েছে। রেসালত সম্পর্কিত সন্দেহ দূর করা হয়েছে।
গ. পুনরুত্থান, পুনর্জীবন, কেয়ামত দিবসে হিসাবের কথা বলা হয়েছে।
পরিশেষে টেন কমান্ডমে-স বা দশ অমূল্য নসিহত পেশ করা হয়েছে। এই উপদেশগুলো পূর্ববতী সমস্ত আসমানি কিতাবে বিদ্যমান ছিল। সমস্ত নবি-রাসুল এই দশ উপদেশের দাওয়াত দিয়ে গেছেন।
সূরাতুল আরাফ!
মূলবক্তব্য: মানবতা শুরু থেকে আখেরাতে ফেরা পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমায় আকিদায়ে তাওহিদ ফুটিয়ে তোলা।
শুরুতে কুরআনের আলোচনা। সমগ্র মানবতার ওপর কুরআন রহমানের নেয়ামত। একপিতা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করে সম্মানিত করাও একটি নেয়ামত। হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বের নমুনাস্বরূপ আদম ও ইবলিসের কিসসা বলা হয়েছে। কেয়ামতের বর্ণনায় তিনটি দলের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে: মুমিন, কাফের ও আরাফে অবস্থানকারী দলের দৃশ্য। কেয়ামতদিবসে সবাই এই তিনদলের দৃশ্য অবলোকন করবে। সেদিন জান্নাতবাসীরা জাহান্নামীদের নিয়ে হাসিমস্করা করবে। এক বিকট আওয়াজ পাপীদের জন্য বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা ডেকে আনবে। জান্নাতি ও আরাফিদের মাঝে পর্দা ফেলে অন্তরায় সৃষ্টি করা হবে। আরাফের ওপর একদল লোক দাঁড়ানো থাকবে। তারা চিহ্ন দেখে অন্যদের চিনতে পারবে। চেহারার শুভ্রতা ও সজিবতা দেখে জান্নাতিদের চিনবে। চেহারার কালিমা ও মলিনতা দেখে জাহান্নামিদের চিনবে।
বিস্তারিতভাবে নবিগণের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ, হুদ, সালেহ, লুত, শোয়াইব ও মুসা আলাইহিমুস সালাম। বনি ইসরায়েলের ওপর নেমে আসা দুঃখ-দুর্দশার কথা বলা হয়েছে। তারপর তারা শান্তিময় জীবন ও প্রাচুর্যময় জীবনের দেখা পেয়েছিল। একসময় বনি ইসরায়েল আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে শুরু করেছিল। শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাদেরকে ঘৃণিত বানর ও শুকরে পরিণত করেছিলেন। ওলামায়ে সুয়ের লাঞ্ছনার দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। ওলামায়ে সু বা মন্দ আলেমের ঘৃণিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তাকে তুলনা করা হয়েছে জিভ বের করে একটানা হাঁপাতে থাকা কুকুরের সাথে। কুকুর সবসময় মাটিকাঁদা ঘেঁটে খায়। এর চেয়ে ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত আর হতে পারে না। আল্লাহ ইলম দিয়েছেন, ওলামায়ে সু সে ইলম ব্যবহার করে দুনিয়ার খুদকুঁড়ো পাওয়ার পেছনে। শেষে তাওহিদের কথা বলা হয়েছে। লাভক্ষতি করতে না পারা উপাস্য, মাটিপাথর পূজো করা ব্যক্তিদের প্রতি বিদ্রƒপ করা হয়েছে। তারা এসবকে আল্লাহর শরিক বানিয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এক। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আকৃতি দিয়েছেন। আল্লাহ মানুষের বিচরণস্থল ও পরিণতিস্থল জানেন।
সূরাতুল আনফাল!
মূলবক্তব্য: বান্দার নিজস্ব কোনো শক্তি-সামর্থ নেই। মানুষকে আল্লাহর আদেশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। বিশ^াস করতে বলা হয়েছে, তার কোনো কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষ সম্পূর্ণই সহায়-সম্বলহীন। এই বিশ^াস থেকেই মানুষ আল্লাহর আদেশ আঁকড়ে ধরবে। ফলে তাদের মাঝে ঐক্য সৃষ্টি হবে, দ্বীনের বিজয় হবে, ফাসাদকারীরা অপদস্থ হবে। শরিয়তের বেশ কিছু ‘মাকাসেদ’, কিতাল ও গনিমত সম্পর্কিত বিধান, শরিয়তের মূলনীতি, সৃষ্টি ও জগত পরিচালনা নীতি, ঐক্যের মূলনীতি, সাধারণ ও বিশেষ বন্ধুত্ব, চুক্তি-অঙ্গীকার, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা, নফস ও উত্তম আদব-আখলাক সম্পর্কিত বিধান বর্ণিত হয়েছে। বিজয় সম্পর্কি যাবতীয় মূলনীতি, বিজয়ের মূল্যবোধ ও বিজয়ের জন্য বস্তুগত উপকরণ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে।
বিজয়ের পরবর্তী সময়ে অহংকার ও শয়তানের প্ররোচনার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। সুরাটি বদরের পরপর নাযিল হয়েছে। বদর ছিল হক ও বাতিলের প্রথম মুখোমুখি লড়াই। অবাধ্যতা, সীমালঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। বদরের মাধ্যমেই বাতিল শক্তি টের পেয়েছে, তাদের শক্তি যতই প্রবল হোক, তাদের দাপট যতই দীর্ঘায়িত হোক, তাদের প্রভুত্ব-আধিপত্য যতই প্রসারিত হোক, তাদের কীর্তি-গীতি যতই উঁচু হোক, অবশ্যই একদিন হক ও ঈমানি শক্তির সামনে মাথা নোয়াতে হবেই। বদর ছিল ইসলামের ইতিহাসে অনাগত হাজারো বিজয়ের সোপান। বদর আল্লাহর সৈনিকদের বিজয়ের সূচনা। সাহাবায়ে কেরাম এই আনফালকে ‘সুরা বদর’ বলতেন। কারণ এই সুরায় বদরের কথা বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। বদরের বিস্তারিত যুদ্ধপরিকল্পনা এই সুরায় বর্ণিত হয়েছে। বাতিলের সামনে মুমিনকে কেমন সাহসিকতা, আস্পর্ধা ও দৃঢ়তা-অবিচলতা-সংকল্পের সাথে রুখে দাঁড়াতে হবে, কেমন বীরত্ব আর কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে হবে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। ময়দান ছেড়ে পালানোর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহ ও রাসুলের পরিপূর্ণ আনুগত্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসুল যেদিকে দাওয়াত দেন, সেটা মুমিনদের জন্য উভয় জাহানে জীবন, সৌভাগ্য, সম্মান বয়ে আনবে। দ্বীন হল হায়াত ও নুর। কুফর হল মওত ও অন্ধকার। ইজ্জত-সম্মানের পথ ও বিজয়ের ভিত স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। শত্রুর সামনে অবিচল থাকা, যুদ্ধের সময় সবর করাই বিজয়ের মূলকথা। এক্ষেত্রে আল্লাহর অপরিমেয় বড়ত্ব, অপরাজেয় শক্তির কথা মাথায় রাখা কর্তব্য। এটা মুমিনকে আত্মিক শক্তি যোগাবে। এই শক্তি বিজয়ের পথে প্রধানতম সহায়ক। আত্মিক শক্তি অর্জিত হয় বেশি বেশি জিকিরের মাধ্যমে। মুমিনদের মাঝে পরিপূর্ণ বন্ধুত্বের কথা বলা হয়েছে। দূরত্ব যতই হোক, জাতিগোত্রে যতই বৈপরীত্ব থাকুক সবাই এক উম্মাহ।
সূরাতুত তাওবা!
মূলবক্তব্য: বিভিন্ন দলের প্রকৃত অবস্থা ফাঁস করা হয়েছে। কাফেরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ, মুনাফিকের মুখোশ উন্মোচন, মুমিনদেরকে অন্যদের থেকে পৃথককরণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের বিধান, জিহাদের মাকাসেদ ও ফাজায়েল, জিহাদকারী দল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। শিথিলতা করে জিহাদে না গিয়ে পিছিয়ে থাকা মুনাফিকক ও তাদের মতো লোকদের কথা বলা হয়েছে। মুমিন, কাফের ও মুনাফিক সবার জন্য তাওবার দরজা খুলে দেয়া হয়েছে। সুরায় প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে,
ক. মুশরিক ও আহলে কিতাবের সাথে ইসলামি শরিয়ার বিধান।
খ. গযওয়া তাবুকে রোমকদের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হওয়ার ঘোষণা দেয়া হলে, কার মনে কী আছে, সেটা প্রকাশ করা।
মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করা ‘ফিফথ কলাম’ (মুনাফিক) সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইসলাম ও মুসলমানের জন্য মুনাফিকরা মুশরিকের চেয়েও বেশি বিপদজনক। তাদের মুনাফিকির পদ্ধতি, তাদের নানা ফন্দিফিকির ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। মুমিনদের মাধ্যমে তাদেরকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। তাদের কোনো কিছুই গোপন রাখা হয়নি। সবই উন্মোচিত করে দেয়া হয়েছে। তাদের অন্তরের গোপন কথাও প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকদের আলামত বলে দেয়া হয়েছে। এই সুরা নাযিলের পর মুমিনগণ সহজেই তাদের সাথে বাস করা মুনাফিকদের চিনে ফেলতে পারতেন। মুনাফিকরা অনবরত ইসলাম ও মুসলমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকত। তারা ইসলাম ধ্বংস ও মুসলমানদের ক্ষতির উদ্দেশ্যে মসজিদের নাম দিয়ে ষড়যন্ত্রখানা খুলেছিল। সেখানে বসে বসে তারা মুসলিম সমাজে ফাটল ধরানোর চক্রান্তে লিপ্ত থাকত। সেটাকে কুরআনে মসজিদে দিরার নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল ও সাহাবীগণ অভিযান চালিয়ে সে মসজিদকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। তাদের চক্রান্ত, কূটকৌশল, অনিষ্ট, হীনপ্রয়াস থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য একমাত্র আল্লাহই যথেষ্ট। কেয়ামত দিবস পর্যন্ত আগত মুনাফিকের পরিচয় দিয়ে দেয়া হয়েছে।
এই সুরায় সবচেয়ে বেশি ‘তাওবা’ ও এই শব্দমূল থেকে নির্গত শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। ১৭ বার নানা আঙ্গিকে তাওবার কথা আছে। অথচ এই সুরায় প্রধানত মুনাফিক ও মুশরিকদের কথাই বেশি বলা হয়েছে। আসলে বারবার তাওবার কথা বলে, সবার প্রতি তাওবার আহ্বান জানানো হয়েছে। তাওবা ছাড়া কারো মুক্তি নেই। সুরায় কঠোর ভাষা, হুমকিধমকি ও তাওবার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী ভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে। যদি তারা তাওবা করতে চায়, তাহলে তাদেরকে প্রথমে আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান আনতে হবে। ঈমানের পূর্বশর্ত পালন করতে হবে। ইসলাম গ্রহণ পূর্বের সমস্ত পাপ ধুয়েমুছে দেয়।
সূরাতু ইউনুস!
মূলবক্তব্য: ওহি অস্বীকারকারীদের সামনে যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন। তাদেরকে তরগিব ও তরহিবের মাধ্যমে ঈমানের দাওয়াত। ঈমানের মূলনীতি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ঈমান ও অন্যান্য রোকন যথা, আসমানি কিতাবের প্রতি ঈমান আনা, বিশেষ করে কুরআনের প্রতি ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে। পুরো সুরাতে আকিদা বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। আলোচনার ঐক্যের কারণে পুরো সুরাকে একটি অখ- গোশতপি-ের মতোই মনে হবে।
শুরুতে রেসালত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। রেসালত ও কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন ও প্রজ্ঞাময় পরাক্রমশালী আল্লাহর কর্মব্যবস্থাপনার পরিচয়বাহী রহমত বর্ণনার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর সিফাতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু নবির কাসাস বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ ও তার কওম, মুসা ও ফেরাওন, ইউনুস আলাইহিমুস সালামের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। এসব কিসসা বলার উদ্দেশ্য, মুমিনদেরকে সাহায্য করা ও জালেমদের ধ্বংস করায় আল্লাহর কর্মনীতি বর্ণনা। রাসুলকে আল্লাহর শরিয়ত আঁকড়ে ধরার হুকুম দেয়া হয়েছে। আল্লাহর রাস্তায় মেহনত করতে গিয়ে সম্মুখিন হওয়া কষ্টযন্ত্রণায় সবর করার হুকুম দেয়া হয়েছে।
সূরাতু হুদ!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর উলুহিয়ত বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। মুমিনদের কলবে আকিদাকে পোক্ত করে বসানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য এই সুরায় রাসুলগণ ও তাদের কওমের মাঝে কথোপকথন বেশ কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কথোপকথনের মাধ্যমেই আকিদা দুরুস্ত করার কাজ করা হয়েছে।
শুরুতেই কুরআনের কথা। এই কিতাবের আয়াতসমূহকে সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। আয়াতসমূহের মাঝে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি, বৈপরীত্ব নেই। কারন এই কুরআন প্রজ্ঞাময় পরাক্রমশালীর তরফ থেকে নাযিল হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সান্ত¡না দেয়ার উদ্দেশ্যে একগুচ্ছ নবি-রাসুলের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ ও তুফানের কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে। হুদের কথা বলা হয়েছে। তার নামে সুরার নামকরণ করে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়ে গিয়ে করা তাঁর মেহনত-মুজাহাদাকে অমর করে রাখা হয়েছে। সালেহ, লুত, শোয়াইব, মুসা ও হারুন আলাইহিমুস সালামের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর নবিগণের কিসসায় জালেমদের ধ্বংসকরণে যেসব শিক্ষা ও নসিহত আছে, সেটা ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব কিসসায় হেদায়াতপ্রাপ্ত ও গোমরাহ দলের কর্মগত তুলনা ফুটে উঠেছে। নিশ্চিত করা হয়েছে, হেদায়াতের পরিণতি ‘নাজাত’, গোমরাহির পরিণতি ধ্বংস। নাজাত বা মুক্তি কারণগুলোও বর্ণনা করা হয়েছে: আল্লাহর আদেশের ওপর অটল অবিচল থাকা, আল্লাহর আদেশ অমান্য না করা, জালেমদের দলে না ভেড়া, দিনের দুই প্রান্তে ও রাতের অংশে সলাত কায়েম করা, আল্লাহর রাস্তায় নিজের ওপর নেমে আসা কষ্টে সবর করা।
রাসুলগুণের কিসসা বর্ণনার হেকমত বলা হয়েছে: আগের যুগে মিথ্যাচারী সম্প্রদায়ের ওপর যা ঘটেছে, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, কষ্ট-যন্ত্রণায় জর্জরিত নবিজির কলবকে সুদৃঢ় করা। এই সুরায় দাওয়াতে তাওহিদের দায়ীদের জন্য একটি বার্তা আছে: তোমরা যে কাজে আছো, তাতে অবিচল থাকো। কারণ চুড়ান্ত পরিণতিতে, আখেরাতের আগে দুনিয়াতেই তোমাদের জন্য উত্তম পুরস্কার আছে। তোমরা শত বিপদাপদ, হাজারো দুঃখকষ্ট, অসংখ্য মনখারাপ করা ঘটনা, অগণিত দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও তোমরা আল্লাহর তত্ত্বাবধানে আছো।
সূরাতু ইউসুফ!
মূলবক্তব্য: নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম কে আশ^াস ও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে: দুঃখকষ্ট (ইবতিলার) পর তামকিন-প্রতিষ্ঠা দেয়া হবে।
পুরো সুরায় ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিসসা বর্ণিত হয়েছে। তিনি ভাই ও মিসরে আজিজের ঘরে অন্যদের থেকে, কারাগারে, নারীদের ষড়যন্ত্রে অনেক দুঃখকষ্ট, যন্ত্রণা-যাতনা সহ্য করেছেন। অবশেষে আল্লাহ তাআলা তাকে দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি দান করেছেন। আল্লাহর রাস্তায় আসা বিপদাপদে সবরের বিনিময়ে আল্লাহ তাকে কারাগার থেকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দিয়েছেন। মিসরের আজিজ বানিয়ে দিয়েছেন। জমিনের ঐশ^র্যের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন সবার প্রিয়, সর্বজনমান্য নেতা। মিসরভূমিতে সম্মানিত আজিজ। তার কিসসা আসন্ন বিজয়ের সুসংবাদ নিয়ে নাযিল হয়েছিল। যারা সবর করবে, নবিরাসুলের পথ অবলম্বন করবে, মুখলিস দায়ীগণের আদর্শ ধারণ করবে, এই সুরা তাদের জন্য পরম সান্ত¡নার কাজ করবে, বিপদে আশার বাণী শোনাবে। এই কিসসায় আছে শিক্ষা ও উপদেশ, ওয়াজ-নসিহত। আছে কুরায়শের নির্যাতনে জর্জরিত নবিজি ও মুমিনদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পরম সান্ত¡না।
আল্লাহর প্রতি নিশ্চিন্ত আস্থা, আল্লাহর প্রতি ভরসাবিশ^াস বান্দাকে আল্লাহর সব ধরণের ফয়সালা ও বিপদে আশাবাদী অবস্থায় সবর করতে সহায়তা করে। মুমিন দৃঢ়বিশ^াস রাখে, জুলুম-নির্যাতন যতই দীর্ঘ হোক, একদিন সুরাহা আসবেই। ইউসুফ আলাইহিস সালামের কিসসাকে কুরআনের সুন্দরতম কিসসা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ,
১. হিংসুক ও হিংসার শিকার ব্যক্তির কথা আছে।
২. মালিক ও মামলুক (মালিকানাধীন ব্যক্তিবস্তুর) কথা আছে।
৩. সাক্ষী ও অভিযুক্তের কথা আছে।
৪. আশেক ও মাশুকের কথা আছে।
৫. আটক হওয়ার পর নিষ্কৃতির কথা আছে।
৬. কারাবাসের পর কারামুক্তির প্রসঙ্গ আছে।
৭. শুষ্কতা ও উষরতার পর উর্বরতা, সজিবতার কথা আছে।
৮. সংকটের পর উত্তরণের কথা আছে।
৯. দুর্যোগের পর সুযোগের কথা আছে।
১০. বঞ্চনার পর প্রাপ্তির কথা আছে।
১১. লাঞ্ছনার পার সম্মানের কথা আছে।
১২. বিচ্ছেদের পর মিলনের কথা আছে।
১৩. দুঃখশোকের পর আনন্দের কথা আছে।
এজন্য বলা হয়, কোনো শোকগ্রস্ত ব্যক্তি এই সুরা বুঝে বুঝে পড়লে, তার মনের ভার কেটে যাবেই।
একনজরে কুরআন কারিম: ২
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
----
সূরাতুর রাদ!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর শক্তি-কুদরতের হাকিকত ও তার প্রকাশ। প্রতিশ্রুতি ও ভীতিপ্রদর্শন। জীবন ও জগতের পরিবর্তন-পরিবর্ধনে আল্লাহর সুন্নাহ বা কর্মকৌশল।
আল্লাহর প্রতি, আল্লাহর কিতাব, রাসুল, পুনরুত্থান ও শেষ প্রতিদানের প্রতি ঈমান রাখার মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। উলুহিয়ত, উবুদিয়তের অর্থ বলা হয়েছে। আল্লাহ এক, তিনিই একমাত্র রিজিকদাতা, জীবন ও মৃত্যুদাতা। তিনিই একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত। জ্ঞান ও মারেফাত হাসিলের মাধ্যম তিনটি,
১: ওহি।
২. আকল।
৩. অনুভূতি বা ইন্দ্রিয়।
প্রথমটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। বাকিদুটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে গায়বি বিষয়ে। বস্তুর বাহ্যিক রূপ থেকে ধোঁকা খাওয়া উচিত নয়। প্রতিটি বিষয়ের গভীরে গিয়ে তার ভেতরের রূপ যাচাই করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। শুরুতে আল্লাহর অস্তিত্ব ও এককত্বের প্রতি ঈমান রাখার কথা। কুরআন সুস্পষ্ট সত্য হওয়া সত্ত্বেও মুশরিকরা কুরআনকে মিথ্যা মনে করেছিল। আল্লাহর একত্বকে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহর কুদরতের পূর্ণতা, সৃষ্টির বিশালতার কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টি, জীবন ও মৃত্যু দানের ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই, এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল উপস্থাপনের মাধ্যমে, পুনর্জীবন ও শেষ প্রতিদানের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। তারপর হক ও বাতিলের দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলের নবুয়ত ও রেসালতের সাক্ষ্যদান বিষয়ক আরেকটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। নবুয়ত একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে।
সূরাতু ইবরাহিম!
মূলবক্তব্য: রাসুল একাধিক হলেও, সবার রেসালতের হাকিকত এক।
কুরআনের এজাযের কথা বলা হয়েছে। এজায মানে অক্ষম করা। কুরআন কারিমের মতো আরেকটি কুরআন সৃষ্টি করতে মানুষ অক্ষম। মোটাদাগে এটিই এজাজুল কুরআনের মূলনির্যাস। কুরআনের মর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে। মুসা আলাইহিস সালামের রেসালতের কথা, কওমকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তার শুকরিয়া আদায়ের দাওয়াত দানের কথা বলা হয়েছে। রাসুলগণকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। যুগে যুগে আগত রাসুলগণ ও তাদের কওমের কথা বলা হয়েছে। রাসুলগণ ও তাদের কওমের মাঝে সংঘটিত কথোপকথন, বিতর্কের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ জালেমদের ধ্বংস করেছেন। আখেরাতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন দুর্ভাগা অপরাধীরা তাদের দুর্বল অনুসারীদের মুখোমুখি হবে। সেদিন দুই পক্ষের দীর্ঘ কথোপকথন, কথা কাটাকাটি হবে। সবাইকে জড়ো করে জাহান্নামে ফেলা হবে। নেতাদের উদ্দেশ্যে অনুসারীদের লানত বর্ষণ সেদিন কোনো কাজে আসবে না। নেতা ও কর্মী কেউ বাঁচতে পারবে না। কেউ কাউকে বাঁচাতে পারবে না। ঈমানি কালিমা ও ভ্রষ্ট কালিমার দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। উভয়টাকে তুলনা করা হয়েছে উত্তম বৃক্ষ ও অনুত্তম বৃক্ষের সাথে। শেষে শেষদিন জালিমদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
সুরাতুল হিজর!
মূলবক্তব্য: মিথ্যাচারী কাফেরদের জন্য অপেক্ষমান ভয়াবহ পরিণতি স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। এটা করা হয়েছে দুই ভাবে,
ক. মিথ্যাচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতি আলোচনার মাধ্যমে।
খ. জগতে দৃশ্যমান আল্লাহর কুদরত ও বড়ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে।
শুরুতে হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। তারপর নবিগণের দাওয়াতের কথা বলা হয়েছে। দুর্ভাগা ভ্রষ্টদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি নবিকেই তাদের ভ্রষ্ট কওম উপহাস করেছে। এটাই সর্বকালে মিথ্যাচারীদের সুনান কা কর্মকৌশল। বিস্ময়কর জগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীর কথা বলা হয়েছে। আসমান, জমিন, পরাগরেণুবাহী বায়ু, জীবন ও মৃত্যু, হাশরনশর-প্রতিটিই আল্লাহর কুদরত ও বড়ত্ব প্রকাশকারী নিদর্শন। আল্লাহর এককত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষী। আদম ও তার ঘোরতর শত্রু ইবলিস সৃষ্টির ঘটনার মধ্য দিয়ে হেদায়াত ও গোমরাহির ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর ইবরহিম, লুত আ. আসহাবে আইকা, আসহাবে হিজরের কথা বলা হয়েছে। এই দুই সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসা আযাবের বর্ণনা করা হয়েছে। রাসুলকে কুরআনের মতো বড় নেয়ামত দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। মুশরিকদের দেয়া কষ্টে রাসুলকে সবর করতে বলা হয়েছে। সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। নবিজি ও মুমিনদেরকে আসন্ন বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সূরাতুন নাহল!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি নেয়ামতই নেয়ামতদাতার পরিচয় বহন করে। হিজরকে সুরাতুন নিয়াম বা নেয়ামতের সুরা বলা হয়। কারণ আল্লাহ এই সুরার শুরুতে নেয়ামতসমূহের মূলনীতি বা কায়েদা বর্ণনা করেছেন। সুরার শেষে নেয়ামতের পূর্ণতা ও পরিণতিদানকারী বিষয়সমূহ উল্লেখ করেছেন।
সুরায় আকিদার বড় বড় বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে: উলুহিয়ত, ওহি, পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান ইত্যাদি। এই বিশাল জগতে, আসমান-জমিনে, সাগর-পাহাড়ে, সমতল-উপত্যকায়, বর্ষিত পানি ও বৃষ্টিতে, বর্ধমান উদ্ভিদে, সাগরে চলমান নৌযানে, রাতের আঁধারে পথিকদের পথনির্দেশক তারকায় আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের দলিল বিদ্যমান। মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত চক্ষু ও কর্ণের মাধ্যমে এসব নিদর্শন ক্রমাগত দেখে যায়। এগুলো আল্লাহর নেয়ামত ও নিদর্শনের জীবন্ত চিত্র, আল্লাহর এককত্বের প্রমাণ, জগতসৃষ্টিতে আল্লাহর অপূর্ব কুদরতের বহিঃপ্রকাশ।
মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার ও শোকর আদায় না করার ফলাফল স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। অস্বীকারকারী ও হঠকারি, একগুঁয়ে ব্যক্তির জন্য যে ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। রাসুলকে হেকমত ও উত্তম কথার মাধ্যমে দাওয়াত দেয়ার আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহর বানী প্রচারের সময় সম্মুখিন হওয়া দুঃখযাতনায় সবর করতে বলা হয়েছে। এজন্য আল্লাহর কাছে প্রভূত প্রতিদান অপেক্ষমান আছে।
সুরাতু বনি ইসরায়েল!
মূলবক্তব্য: কুরআন কারিমের মর্যাদা, রেসালতে মুহাম্মদির পূর্ণতা বর্ণিত হয়েছে।
শুরুতে ইসরা-মেরাজের বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মেরাজের ঘটনা ছিল নবিজির প্রতি আল্লাহর সম্মান প্রদানের সুস্পষ্ট নিদর্শন, আশ্চর্যজনক ঘটনা সৃষ্টিতে আল্লাহর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। বনি ইসরায়েল সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাদের বিশৃঙ্খলা ও অবাধ্যতার কারণে দুই বার তাদেরকে আপন বাসস্থান থেকে বিতাড়িত হওয়াটা আল্লাহ অবধারিত করে দিয়েছেন। খালেক বা সৃষ্টিকর্তার এককত্ব ও কুদরতের পরিচয়বাহী কিছু মহাজাগতিক নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। শরয়ি কিছু আদব ও মহোত্তম আখলাকের কথা বলে এগুলোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এগুলো দ্বারা নিজেকে সজ্জিত করতে বলা হয়েছে। মুশরিকদের গোমরাহি সম্পর্কে বলা হয়েছে। তারা আল্লাহর জন্য সঙ্গীনি ও সন্তান সাব্যস্ত করেছিল। বিস্ময়ের বিষয় হল, তারা নিজেদের জন্য কন্যাসন্তান অপছন্দ করলেও, আল্লাহর জন্য ঠিকই কন্যা সাব্যস্ত করত। অথচ আল্লাহ সমস্ত সাদৃশ্য, সমদর্শিতা থেকে পবিত্র। পুনরুত্থান, পুনর্জীবন ও প্রতিদান সম্পর্কে বলা হয়েছে। এসব তখন বিষয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছিল। আল্লাহ কেয়ামত, হিসাব, প্রতিদানের অবশ্যম্ভাবিতার সপক্ষে অকাট্য দলিল প্রমাণ তুলে ধরেছেন। তারপর কুরআন কারিম সম্পর্কে বলা হয়েছে। মুশরিকরা বিভিন্ন হঠকারি প্রস্তাবনা পেশ করেছিল। তারা কুরআন কারিম ছাড়া অন্য মুজিযা দাবি করেছিল। সুরার শেষে আল্লাহকে যাবতীয় শরিক ও সন্তানমুক্ত মহাসম্মানিত ঘোষণা করা হয়েছে। যাবতীয় অসম্পূর্ণতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, অক্ষমতা-দুর্বলতা থেকে পবিত্র বলা হয়েছে। আল্লাহকে নিরংকুশ সম্মান ও মহিমার অধিকারী বলা হয়েছে। এই কুরআন শব্দটি ১১ বার আলোচিত হয়েছে। আর কোনো সুরায় এতবার শব্দটি উল্লেখিত হয়নি। এতে একটি সূক্ষè ইঙ্গিত আছে বলে মনে করা হয়: একটি পরিপূর্ণ কুরআনি প্রজন্ম ছাড়া কুদসের চূড়ান্ত বিজয় সম্ভব নয়।
সূরাতুল কাহফ!
মূলবক্তব্য: ফিতনা থেকে সুরক্ষা।
দুনিয়ার জীবনে মুমিনকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অসংখ্য ফিতনার সম্মুখিন হতে হয়। একের পর এক ফিতনা আসতেই থাকে। ফিতনার তোড়ে পরম ধৈর্যশীলও অনেক সময় হয়রান হয়ে যায়। শাসকের ফিতনা, যৌবনের ফিতনা, পরিবার-পরিজনের ফিতনা, সম্পদের ফিতনা, সন্তানের ফিতনা, নশ^র দুনিয়ার ধোঁকাময় ফিতনা, ইবলিসের ফিতনা, ইলমের ফিতনা, ইয়াজুজ-মাজুজের ফিতনা, প্রবৃত্তির ফিতনা।
সুরা কাহফে এসব ফিতনা ও এগুলোর ঝুঁকির কথা বলে সতর্ক করা হয়েছে। আমাদের সামনে ফিতনা থেকে সুরক্ষার পথ তুলে ধরা হয়েছে, মুক্তির পথ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটা সম্ভব হবে রব্বানি মানহাজ অনুসরণ, আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা ও আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আশ্রয় গ্রহণ, আমাদের চেতনা, চিন্তা ও বুঝশক্তির মানদ- বিশুদ্ধকরণ, জীবনের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ, সৎসঙ্গ অবলম্বন, দুনিয়া আখেরাতের শস্যক্ষেত্র-এই আকিদা পোষণ, উপকারি ইলম দ্বারা নিজেকে সুরক্ষিতকরণ, বিশুদ্ধ ইবাদত দ্বারা পাথেয় গ্রহণ, সবর ও অবিচলতা অবলম্বন, মহোত্তম আখলাক ধারণ, পূর্ববর্তীদের কাসাস থেকে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে। এসব গুণাবলী মুমিনকে আখেরাতের বিপদ থেকে রক্ষা করে, ঠিক যেমনিভাবে কাহফ বা গুহা মানুষকে হিং¯্র বন্যপ্রাণী ও বিপদাপদ থেকে সুরক্ষা ও আশ্রয় দেয়। প্রাকৃতিক কাহফের মতো এই সুরাও পাঠকারীর জন্য যাবতীয় ফিতনা থেকে সুরক্ষাদানকারী গুহার ভূমিকা পালন করবে। আমার কর্তব্য এই গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করা। তাহলে রব্বে কারিম আমার ওপর তার রহমত বিস্তার করবেন।
এই সুরায় অপূর্ব তিনটি কুরআনি কাসাস বর্ণিত হয়েছে। কাসাসগুলো বর্ণনার প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে: আকিদা পোক্ত করা, আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত সুদৃঢ় করা,
প্রথম কিসসা: আসহাবে কাহফের কিসসা। নিজের বিশুদ্ধ আকিদা সুরক্ষিত রাখার জন্য জানমাল উৎসর্গ করা। একদল মুমিন যুবক নিজেদের দ্বীন ও ঈমান বাঁচাতে সমাজ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আশ্রয় নিয়েছিলেন পাহাড়ের গুহায়। সেখানে ৩০৯ বছর একটানা ঘুমিয়ে ছিলেন। তারপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
দ্বিতীয় কিসসা: মুসা ও খিজির আলাইহিমাস সালামের কিসসা। ইলম তলবের জন্য বিনয় অবলম্বন করা, মেহনত ও সফর করার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কিছু গায়বি বিষয় মুসার আগেই খিজিরকে অগ্রিম জানিয়ে দিয়েছিলেন।
তৃতীয় কিসসা: জুলকারনাইনের কিসসা। তিনি ছিলেন একজন মুত্তাকি ও ইনসাফকারী বাদশাহ। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তার শাসনক্ষমতা ছড়িয়ে ছিল। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম দিগন্ত পর্যন্ত তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। তিনি এক মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।
সুরা কাহফে চার প্রকার ফিতনার কথা বলা হয়েছে। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় ফিতনা আর হতে পারে না,
১: দ্বীনের ফিতনা। আসহাবে কাহফ এই ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আল্লাহ তাদেরকে এই ফিতনা থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারা দ্বীন ও ঈমান নিয়ে কুফরপূর্ণ সমাজ-রাষ্ট্র থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
২. সম্পদের ফিতনা। দুই বাগিচার মালিকদ্বয় এই ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিল। একজন বাগানমালিক এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিল। আল্লাহ তার সম্পদ নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন।
৩. ইলমের ফিতনা। খিজির ও মুসা আলাইহিমাস সালামের কিসসায় এই ফিতনার স্বরূপ ফুটে উঠেছে। খিজির ইলম পেয়ে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।
৪. ক্ষমতা ও রাজত্বের ফিতনা। জুলকারনাইনের কিসসায় এই ফিতনার স্বরূপ উঠে এসেছে। তিনি এই ফিতনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এতবড় নেয়ামতের শোকর আদায় করার কারণে আল্লাহ তাকে ফিতনা থেকে মুক্ত রেখেছিলেন। তিনি তার সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করেছিলেন। যাবতীয় ক্ষমতা তিনি মানুষের মাঝে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করেছিলেন।
এই সুরায় কয়েকটি বাস্তবনির্ভর দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সম্পদ ও ক্ষমতার আধিক্যের সাথে হকের কোনো সম্পর্ক নেই। হকের সম্পর্ক বিশুদ্ধ আকিদার সাথে।
প্রথম দৃষ্টান্ত: আপন ধন-সম্পদ নিয়ে দম্ভকারী ধনাঢ্য ব্যক্তি ও আকিদা ও ঈমান নিয়ে আপন শক্তিতে বলিয়ান গরিব ব্যক্তি। এটা দুই বাগান মালিকের ঘটনায় ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত: পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব, ধ্বংসশীলতা।
তৃতীয় দৃষ্টান্ত: অহংকার ও দম্ভ। ইবলিস আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করত অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ কারণে সে বিতাড়িত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল।
এসব গল্প ও কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে মূলত আমাদের উপদেশ ও নসিহার জন্য।
সূরাতু মারয়াম!
মূলবক্তব্য: সুরা মারয়ামে দুটি সিফাতের কথা আলোচিত হয়েছে। দুটি সিফাতই একটি অপরটির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। একটি অপরটির জন্য আবশ্যকও বটে।
১: রহমত বা দয়া। এই সিফাত আল্লাহ তাআলা যে পরিপূর্ণ রব, তার বাস্তব প্রমাণ। জগতের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আল্লাহর রহমতের ছোঁয়া ও মায়া জড়িয়ে আছে। প্রতিটি সৃষ্টিতে রব্বে কারিমের রহমত অনবরত উপচে পড়ছে।
২. উবুদিয়ত-দাসত্ব। আল্লাহর দাসত্বই একজন মানুষকে পূর্ণতার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দেয়। এই সিফাতের মাধ্যমে মানুষ তাকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, তার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়। আল্লাহর উবুদিয়তে নিহিত আছে, সম্মান, উত্তরণ, মুক্তি, স্বাধীনতা,পরিশুদ্ধি, বিন¤্রতা, আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠাময় আত্মমগ্ন আত্মনিবেদন।
রহমত আল্লাহ তাআলা পূর্ণ রুবুবিয়তের পরিচায়ক হলে, বিশুদ্ধ ও পূর্ণ উবুদিয়ত হল মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য। পরম ইবাদতগুজার সিদ্দিকা মারয়ামকে তার আম্মা আল্লাহর একনিষ্ঠ ইবাদতের জন্য মানত করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন মারয়াম। এর অর্থ আবেদা-ইবাদতগুজার মেয়ে। আল্লাহ তার বন্ধুদেরকে স্বীয় রহমত দ্বারা বেষ্টন করে রেখেছেন। এই সুরায় বর্ণিত রাসুলগণের আলোচনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, মুমিন তার পরিবার-পরিজন, সন্তান ও পরবর্তী বংশধরদের সততার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে।
শুরুতে যাকারিয়া ও সন্তান ইয়াহয়া আলাইহিমাস সালামের কথা বলা হয়েছে। অতি বৃদ্ধ পিতা যাকারিয়ার ঔরস ও বন্ধ্যা মাতার গর্ভ থেকে আল্লাহ ইয়াহয়ার জন্ম দিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি দুঃখি হাহাকার ভরা দোয়া শোনেন, শোকাকুল ব্যক্তির ডাকে সাড়া দেন। তারপর কুমারি মারয়ামের অত্যন্ত বিস্ময়কর আর অবিশ^াস্য কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি পিতা ছাড়া সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তারপর ইবরাহিম ও তার পিতার কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা, হারুন, ইসমাঈল, ইদরিস ও নুহ আলাইহিমুস সালামের গুণবর্ণনামূলক প্রশংসা করা হয়েছে। তারপর কেয়ামতের কিছু ভয়াবহ দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শেষে আল্লাহকে সন্তান ও শরিক থেকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। মুশরিকদের গোমরাহি সুস্পষ্ট ভাষা ও অকাট্য দলিলের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই সুরায় ‘রহমান’ সিফাতটি ১৬ বার উল্লেখিত হয়েছে। রহমত শব্দটি ৪ বার উল্লেখিত হয়েছে। এর মাধ্যমে যেন বোঝানো হয়েছে, এই সুরার মূল মাকসাদ বা উদ্দেশ্য: মুমিনের আকিদায় আল্লাহর রহমত সিফাতটির প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি মুশরিকদের রদ করাও উদ্দেশ্য ছিল। মুশরিকরা আল্লাহ তাআলার ‘রহমান’ সিফাতটি অস্বীকার করত। সুরা ফুরকানে আছে,
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمُ اسْجُدُوۡا لِلرَّحْمٰنِ قَالُوْا وَ مَا الرَّحْمٰنُ ٭
৬০
সূরাতু তোয়াহা!
মূলবক্তব্য: দ্বীনের দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য বাছাইকৃত রাসুলগণ ও তাদের অনুসারীদের প্রতি আল্লাহর তত্ত্বাবধান ও যাদেরকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে, তাদের প্রতি কোমলতা আর গুরুত্ব প্রদর্শন।
এ বিষয়ের নুমনা হিসেবে মুসা আলাইহিস সালামও অত্যাচারী, সীমালঙ্ঘনকারী ফেরাওনের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। রবের কাছে মুসার মুনাজাতের কথা বলা হয়েছে। মুসাকে রেসালতের দায়িত্ব দেয়ার কথা আছে। মুসা ও ফেরাওনের বিতর্কের কথা আছে। মুসা ও জাদুকরদের লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে। এসব ঘটনায় ফুটে উঠেছে, আল্লাহ তার প্রিয় নবিকে আগলে রেখেছিলেন, নিজ তত্ত্বাবধানে রেখেছিলেন। তার শত্রুদের ধ্বংস করেছিলেন। যারা ছিল কাফের, অপরাধী। সংক্ষেপে আদম আলাইহিস সালামের কথা বলা হয়েছে। ভুল করার পরও আল্লাহ আদমের প্রতি রহমত নাযিল করেছেন। তাদের হেদায়াত দান করেছেন। হাশর দিবসের কথা আছে। সেদিন ইনসাফের সাথে হিসাবনিকাশ হবে। আনুগত্যকারীরা সন্তুষ্টচিত্তে জান্নাতে চলে যাবেন। অবাধ্যদেরকে জাহান্নামে জড়ো করা হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে কিছু দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সবর করতে বলা হয়েছে। বিজয় আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় কষ্ট সহ্য করতে বলা হয়েছে।
সূরাতুল আম্বিয়া!
মূলবক্তব্য: তাওহিদের নিদর্শনাবলী, নবিগণের দাওয়াতে পুনর্জীবনের প্রসঙ্গ ও এ বিষয়ে মানুষের অবস্থান।
মানুষ আখেরাত সম্পর্কে গাফেল অথচ কেয়ামত অতি সন্নিকটে। মিথ্যাচারীদের কথা বলা হয়েছে। তারা বিগতদের পরিণতি দেখার পরও শিক্ষা গ্রহণ করে না। জীবন ও জগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর এককত্বের সাক্ষ্যদানকারী আল্লাহর কুদরতের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। তারা নবি-রাসুলকে উপহাস করত, মিথ্যা সাব্যস্ত করত। অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীক ভঙ্গিতে ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, লুত, নুহ, দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইসমাঈল, ইদরিস, যুলকিফল, ইউনুস, মুসা, হারুন, যাকারিয়া ও ঈসা আলাইহিমুস সালামের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ভীতি ও হুমকিও প্রদর্শন করা হয়েছে। তাদের কিসসায় নসিহত ও ইবরতও আছে। তাদের কিসসা থেকে কেবল বিশুদ্ধ অন্তর ও চিন্তার অধিকারী মানুষই কেবল শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালতের কথা বলা হয়েছে।
সূরাতুল হজ!
মূলবক্তব্য: উম্মাহ গঠনে হজ ফরজ করার ভূমিকা।
কেয়ামতকালে ঘটিতব্য ভয়ানক ভূমিকম্পের কথা বলা হয়েছে। পুনর্জীবনের সপক্ষে দলিল দেয়া হয়েছে। কেয়ামতের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন পুণ্যবানরা জান্নাতে, পাপীরা জাহান্নামে যাবে। বায়তুল্লাহর পবিত্রতা ও হজ ফরজ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। হজের উপকারিতা, হজের বিধান, হজের শাআয়ের বা প্রতীক, হজসাধন পদ্ধতি, কুরবানির জন্তু সম্পর্কে বলা হয়েছে। কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতালের অনুমতি দেয়ার হেকমত সম্পর্কে বলা হয়েছে। জুলুম ও অবাধ্যতার কারণে বিধ্বস্ত হওয়া জনপদসমূহের আলোচনার মাধ্যমে, মিথ্যাচারীদের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতি তুলে ধরা হয়েছে। এসব বলে মুসলিমদের সান্ত¡না দেয়া হয়েছে যে, সবরকারীদের জন্য উত্তম পরিণতি অপেক্ষা করছে। মূতিপূজারী মুশরিকদের উদ্দেশ্যে দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। এসব ভ্রান্তু উপাস্যগুলো শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী মানুষ সৃষ্টি তো দূরের কথা, একটি মাছি সৃষ্টিতেও অক্ষম। মিল্লাতে ইবরাহিম অনুসরণের দাওয়াত দেয়া হয়েছে।
সূরাতুল মুমিনুন!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর এককত্ব প্রমাণ। শিরক ও তার নীতিমালাসমূহ বাতিল করা হয়েছে। ঈমান ও শরিয়তের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ঈমানদারদের সাফল্যের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। ঈমানদারদের কীর্তি ও উন্নত আখলাক-ইবাদতের কথা বলা হয়েছে। এসবের বিনিময়ে মুমিনগণ জান্নাতুল ফিরদাওস লাভ করবেন। আল্লাহর কুদরতের দলিল পেশ করা হয়েছে। কয়েকজন নবির কিসসা বলা হয়েছে। এসব বলে আমাদের নবিজিকে সান্ত¡না দেয়া হয়েছে। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সপক্ষে দলিলপ্রমাণ পেশ করা হয়েছে। অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বাতিলকে রদ করা হয়েছে। মৃত্যুর সময় কাফের যে ভয়ানক পরিস্থিতি ও যন্ত্রণার সম্মুখিন হয়, তার কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত দিবসে মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা।
সূরাতুন নূর!
মূলবক্তব্য: চারিত্রিক নিষ্কলুষতা ও দোষত্রুটি ঢেকে রাখা। মুসলিম ব্যক্তি-সমাজ গঠন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়-পালনীয় কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে। পরিবার সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও দিকনির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে। বৃহত্তর সমাজ গঠনে পরিবার বীজের ভূমিকা পালন করে। পরিবার সমাজের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সুরায় পরিবারিক সমস্যা-সংকট, পরিবারব্যবস্থা বিধ্বংসী বিষয়সমূহের সমাধান করা হয়েছে। এছাড়াও আছে মহোত্তম আদব-আখলাক, গভীর প্রজ্ঞা, গুরুত্বপূর্ণ দিকনিদের্শনা, উত্তম জীবন গঠনে সহায়ক হেকমতপূর্ণ নসিহত। এজন্য ওমর রা. কুফাবাসীর কাছে লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘তোমরা নারীদেরকে সুরা নুর শিক্ষা দাও’।
যেনা, অপবাদ, লেআনের হুদুদ বর্ণনা করা হয়েছে। শরিয়তের কিছু আদব ও আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে। যথা, ঘরে প্রবেশের সময় অনুমতি প্রার্থনা, দৃষ্টি অবনত রাখা, লজ্জাস্থানের হেফাজত করার কথা বলা হয়েছে। বেগানা নারী ও পুরুষের মেলামেশা হারাম করা হয়েছে। মুসলিম পরিবার গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান চারিত্রিক নিষ্কলুষতা। প্রতিটি মুসলিম পরিবারে পবিত্রতা ও পর্দাপুশিদা থাকা উচিত। সমাজের শুদ্ধতা শুরু হয় ইবাদতের প্রভাবে। ইবাদতের মূল হল: সলাত। সলাতে আসে কলবের পবিত্রতা। পবিত্র আত্মা ছাড়া বিশুদ্ধ সমাজ গঠিত হয় না। মসজিদ ও তার অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। মসজিদ আবাদকারী, মসজিদে আগমনকারী, মসজিদের সাথে লেগে থাকা ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সূরাতুল ফুরকান!
মূলবক্তব্য: কুরআনের মুজিযার মাধ্যমে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতার প্রমাণ দেয়া হয়েছে। আকিদা বিষয়ক আলোচনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কুরআন ও রাসুলের রেসালত সম্পর্কে মুশরিকদের সন্দেহ অপনোদন করা হয়েছে। কুরআনের সত্যতা সাব্যস্ত করা হয়েছে। দলিল দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে, কুরআন রবের পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন ও প্রতিদান সাব্যস্ত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী মিথ্যাচারী কওমে মুসা, নুহ, আদ, সামুদ ও আসহাবে রসসের ভয়াল পরিণতির চিত্র আঁকা হয়েছে। তাদের ওপর নেমে এসেছিল নানা প্রকারের আযাব। তাদের অবাধ্যতা ও আল্লাহর রাসুলকে অস্বীকার করার কারণে এই আযাব দেয়া হয়েছিল। আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের সপক্ষে দলিল দেয়া হয়েছে। আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও উন্মুক্ত বিশে^ ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর সৃষ্টির নিদর্শন সম্পর্কে বলা হয়েছে। রহমানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে প্রশংসনীয় আখলাক দ্বারা সম্মানিত করেছেন। যার বিনিময়ে তারা জান্নাতে বিরাট প্রতিদানের উপযুক্ত হবেন।
সূরাতুশ শুআরা!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর রাসুলকে অস্বীকারে অনঢ়, রাসুলের রেসালতের সমালোচনাকারী, রাসুলগণের অসম্মানকারী ব্যক্তিদের প্রতিরোধ করা হয়েছে।
শুরুতে কুরআন কারিমের আলোচনা। আল্লাহ মানুষের হেদায়াতের জন্য কুরআন নাযিল করেছেন। কুরআনে আছে মানবতার যাবতীয় রোগ-বালাইয়ের আরোগ্যনিদান। কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। মুসা থেকে শুরু করে শোয়াইব আলাইহিমুস সালামের কাসাস বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর রেসালত প্রচার করতে গিয়ে তারা যে কষ্ট ও সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা উল্লেখ করা হয়েছে। শয়তানের বন্ধুদের ওপর রহমানের বন্ধুদের বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, কুরআন শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। তাদের এই অমূলক ধারণা রদ করা হয়েছে।
সূরাতুন নামল!
মূলবক্তব্য: রাসুলকে আল্লাহ তাআলা বৃহত্তম নিদর্শন কুরআন দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন। এজন্য রাসুলকে শোকর আদায় করতে উৎসাহ দিয়েছেন। সবরের সাথে এই কুরআন প্রচার করতে বলেছেন।
শুরুতে কুরআনের বালাগাত বা আলংকারিক সৌন্দর্য, ব্যাপক অর্থময়তা, কুরআনের মর্যাদা বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কিছু নবির কাসাস সংক্ষেপে, কিছু নবির কাসাস বিশদে বর্ণনা করা হয়েছে। সুলাইমান আলাইহিস সালামের রাজত্বের কথা বলা হয়েছে। তার কিসসায় আছে ক্ষমতা ও রাজদ-ের অধিকারীদের জন্য সূক্ষè শিক্ষা। সুলাইমান রাজশক্তিকে আল্লাহর দিকে দাওয়াতের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার যুগে বাস করা প্রতিটি জালেম ও কাফের শাসককে তিনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। একই ঘটনা ঘটেছিল রাণী বিলকিসের ক্ষেত্রে। বিলকিস দাওয়াত পেয়ে মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছিলেন। রহমানের দাওয়াতে বিলকিস সসৈন্যে অনুগত বশীভূত হয়ে সুলাইমানের কাছে এসেছিলেন। সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শনের মাধ্যমে আল্লাহর কুদরত ও একতত্বের দলিল দেয়া হয়েছে। হাশরদিনের ভয়ংকর কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মানুষ এসব দেখে সেদিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: সৌভাগ্যবান, পুণ্যবান, কাফের ও ফাসেক।
সূরাতুল কাসাস!
মূলবক্তব্য: অহংকারীদের ধ্বংস, দুর্বলদের সাহায্য করার ব্যাপারে, আল্লাহর সুনান-কর্মকৌশল ও কুদরত প্রকাশের মাধ্যমে শক্তির প্রকৃত মানদ- বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এই সুরা নাযিলের সময় মক্কায় সীমিত সংখ্যক মুসলিম অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ছিলেন। মুশরিকরা শক্তি ও দাপটে প্রবল ছিল। তখন শক্তি ও মূল্যবান হওয়ার প্রকৃত মানদ- পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই জগতে একটাই মাত্র শক্তি আছে-আল্লাহর শক্তি। এই জগতে একটাই মাত্র মূল্যবান বস্তু আছে-ঈমান। যার সাথে আল্লাহর শক্তি আছে, বাহ্যিক দৃষ্টিতে সে একা হলেও তার কোনো ভয় নেই। যার সাথে আল্লাহর শক্তি নেই, তাকে দুনিয়ার সবাই সাহায্য করলেও, তার কোনো শান্তি ও নিরাপত্তা নেই। যার সাথে ঈমান আছে, তার সাথে সমস্ত কল্যাণ আছে। যার কাছে ঈমান নেই, কোনো কিছুই তার জন্য উপকারী হতে পারে না।
হক ও বাতিলের কথা বলা হয়েছে। আনুগত্য ও অবাধ্যতার কথা বলা হয়েছে। হিযবুর রহমান ও হিযবুশ শয়তানের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে দুটি কিসসা বলা হয়েছে,
১: শাসনক্ষমতা ও প্রতিপত্তি পেয়ে সীমালঙ্ঘন করা। অত্যাচারী ফেরাওনের ঘটনায় এটা ফুটে উঠেছে। সে বনি ইসরায়েলকে চরম নির্যাতন করেছিল। শিশুদের জবাই করে, নারীদের জীবিত রাখত। আল্লাহর ওপর অহংকার করে বলেছিল (اَنَا رَبُّكُمُ الْاَعْلٰی) আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব (নাযিআত: ২৪)। আল্লাহ তাকে সাগরে ডুবিয়ে মেরেছেন। তারা জুলুমের কারণেই মুসাকে তার সাগরে ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন ফেরাওনকে সেই শাস্তি ভোগ করতে হল।
২. ধনসম্পদ দিয়ে অহংকার, দম্ভ করা। কারুন তার কওমের সাথে এমন করেছিল।
উভয় ঘটনাই ইহজীবনে মানুষের অবাধ্যতার নিদর্শন। একটাতে সম্পদের দম্ভ, আরেকটাতে ক্ষমতার দম্ভ। মক্কার কাফেরদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তারা রাসুলের দাওয়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। ভ্রষ্টদের পথচলা ও পরিণতি এক। সৌভাগ্যের পথ দেখানো হয়েছে। সেটা হল ঈমানের পথ। এই পথের দিকেই সম্মানিত রাসুলগণ মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন।
সূরাতুল আনকাবূত!
মূলবক্তব্য: ইবতিলা-ফিতনা বা পরীক্ষার সময় সবরের সাথে অবিচল থাকা। ইবতিলা বা পরীক্ষা এই জীবনেরই অনিবার্য অংশ। মুসলমানরা মক্কায় চূড়ান্ত কষ্ট ও নির্যাতনের মাঝে ছিলেন। এজন্যই ফিতনা-ইবতিলা মানে পরীক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে নবিগণের কিসসাও বর্ণনা করা হয়েছে। তারা অবিশ^াস্য চেষ্টা-মুজাহাদা করেছিলেন। অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছিলেন।
নুহ আলাইহিস সালাম সাড়ে নয়শ বছর কওমকে দাওয়াত দিয়েছেন। অল্প কজন ছাড়া বাকিরা কেউ ঈমান আনেনি। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার কওমের পেছনে সর্বাত্মক মেহনত করেছিলেন, তাদের সাথে যুক্তিতর্ক দিয়ে লড়াই করেছিলেন। কাজ হয়নি। কওম ইবরাহিমের সাথে অবাধ্যতা করেছিল। সীমালঙ্ঘন করেছিল। কওমে লুত কোনও লাজলজ্জা ছাড়াই ন্যক্কারজনক অশ্লীল কাজ করত। বিভিন্ন আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালতের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের কিছু দলিল দেয়া হয়েছে। কষ্টের দিনে সবরকারীদের জন্য প্রতিদান আছে। জানমাল দিয়ে মেহনতকারী ও ইবতিলা-মেহনত-পরীক্ষার সময় অবিচল থাকা ব্যক্তিদের জন্যও সম্মানজনক প্রতিদান আছে। হক ও দ্বীনের সাহায্যে আত্ম ও অর্থত্যাগের যথোপযুক্ত প্রতিদান আছে।
সূরাতুর রূম!
মূলবক্তব্য: সুরা রূম মানুষের অবস্থা ও জীবনের নানা ঘটনার মাঝে গভীর যোগসূত্র উন্মোচন করে দেখায়। মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মাঝে যোগসূত্র দেখিয়ে দেয়। জগতের রীতিনীতি ও অস্তিত্বের নিয়মনীতির মাঝে যোগসূত্র দেখিয়ে দেয়। প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি জন্মসৃষ্টি, প্রতিটি জয়-পরাজয় এক সূক্ষè সুবিন্যস্ত বন্ধনে আবদ্ধ। জগতের সবকিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে,
لِلهِ الْاَمْرُ مِنْ قَبْلُ وَ مِنْۢ بَعْدُ
রূম: ৪
শরুতেই এক গুরুত্বপূর্ণ গায়বি সংবাদ দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঘটার আগেই কুরআন সংবাদটি জানিয়ে দিয়েছে: পারস্যের ওপর রোমকদের বিজয়। হিযবুর রহমান ও হিযবুশ শয়তানের মাঝে লেগে থাকা চিরন্তন যুদ্ধের হাকিকত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মানবসৃষ্টির সূচনা থেকেই এই যুদ্ধ চলে আসছে। যতদিন হক ও বাতিল, ভালো ও মন্দ, কল্যাণ ও অকল্যাণ, ইসলাম ও কুফরের অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন যুদ্ধ থামবে না। শয়তান তার সাঙ্গপাঙ্গদের জড়ো করে যাবে: আল্লাহর নুরকে নেভানোর জন্য, রাসুলগণের দাওয়াতের বিরোধিতা করার জন্য।
কেয়ামতের ভয়াবহতা এবং সেদিন কাফের ও ভ্রষ্টদের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুমিনগণ সেদিন জান্নাতে আনন্দে মগ্ন থাকবে। অপরাধীদের আযাবে হাজির করা হবে। আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের পরিচয়বাহী জাগতিক কিছু দৃশ্য ও গায়বের কিছু দলিল তুলে ধরা হয়েছে। কাফের কুরায়শ সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাদের দেয়া কষ্টে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবর করতে বলা হয়েছে। আল্লাহর সাহায্য আসবেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে বলা হয়েছে। এই সুরার সবচেয়ে বড় কথা হল: আল্লাহ তাআলা মানুষকে দ্বীন ইসলামের ওপরই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্য কিছুর তালাশ করাটা, আল্লাহর সৃষ্টি বদলে দেয়ার নামান্তর। এ এক ভয়ংকর বিকৃতি।
একনজরে কুরআন কারিম: ৩
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
--
সূরাতু লুকমান!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর আয়াত-নিদর্শনাবলী ও নেয়ামতরাজি, ঈমান ও শোকরের দিকে দাওয়াত বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
শুরুতে প্রজ্ঞাময় কিতাবের কথা। রাব্বুল আলামিনের এককত্বের ওপর যুক্তিপ্রমান পেশ করা হয়েছে। আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, দিনরাত, সাগর-পাহাড়, বৃষ্টি-ঢেউ, গাছপালা-উদ্ভিদসহ এই বিস্তৃত বিশে^র প্রতি বস্তুতে আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টিকুশলতা ও কুদরতের সুস্পষ্ট দলিল বিদ্যমান আছে। মানুষের চোখে দৃশ্যমান প্রতিটি বস্তুতে আল্লাহর কুদরত ও এককত্বের প্রমাণ বিদ্যমান। আল্লাহর কুদরত নিয়ে ভাবলে মনমনন অভিভূত হয়ে যায়। লুকমান হাকিমের আলোচনা করা হয়েছে। তার কিসসায় হেকমতের ফজিলত, শিরকের নিন্দা, মহোত্তম আখলাকের প্রতি উৎসাহ, হীনমন্দ স্বভাবের প্রতি নিরুৎসাহ ফুটে উঠেছে। লুকমানের ঘটনায় বেশি কিছু মূল্যবান নসিহত আছে। শয়তানের আহ্বানের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। গায়বের সংবাদ জানা নিয়ে জ্যোতিষিদের ভ্রান্ত দাবির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
সূরাতুস সাজদা!
মূলবক্তব্য: কুরআনের ব্যাপারে দৃঢ় বক্তব্য উপস্থাপন। তাকদির বাদে ঈমানের মৌলিক ছয়টি উসুল বর্ণনা।
শুরুতে কুরআনের কথা। কুরআনের এজাযের কথা বলা হয়েছে। কুরআন আয়াতসমূহ স্পষ্ট, বিধানসমূহ সমুন্নত। মুশরিকরা অপবাদ দিয়েছিল: কুরআন রাসুলের নিজস্ব বানানো। উর্ধজগত ও নি¤œজগতে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর কুদরতি নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকরা পুনর্জীবনকে অস্বীকার করে, অকাট্য দলিলের মাধ্যমে তাদের এই ভ্রান্ত বিশ^াসকে রদ করা হয়েছে। কেয়ামতের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে: সেদিন অপরাধীরা লাঞ্ছিত অপদস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে, আখেরাত সম্পর্কে তাদের দৃঢ় একিনের কথা বলবে। হিসাব দিবসের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ মুত্তাকিদের জন্য স্থায়ী নেয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছেন। অপরাধীদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক আযাব প্রস্তুত করে রেখেছেন।
সূরাতুল আহযাব!
মূলবক্তব্য: মুসলমানের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবন, বিশেষ করে পারিবারিক জীবন এই সুরায় গুরুত্ব পেয়েছে। সমাজে সুখ ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তাজ্ঞাপক বিধান জারি করা হয়েছে। জাহেলি যুগ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে চলে আসা কিছু রীতিপ্রথা বাতিল করা হয়েছে: পালকপুত্র, জিহার, একজনের দুটি হৃদপি- থাকা ইত্যাদি। সমাজকে জাহেলি প্রথা থেকে পবিত্র করা হয়েছে। সে যুগে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া কাল্পনিক, মনগড়া কল্পকাহিনী, কুসংস্কার দূর করা হয়েছে।
সুরা আহযাবে আলোচিত বিষয় ও এই সুরার প্রধানতম উদ্দেশ্যকে সংক্ষেপে তিনভাগে ভাগ করা যায়,
১: দিকনির্দেশনা, ইসলাম আদব-শিষ্টাচার বর্ণনা। ওলিমার আদব, আব্রু ও হিজাব, সৌন্দর্য প্রদর্শনী না করা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ওঠাবসার আদবসহ আরো কিছু সামাজিক আদব বর্ণিত হয়েছে। মুমিনের জীবনকে সুখশান্তিময় করতেই মূলত আল্লাহ তাআলা আদবগুলো প্রণয়ন করেছেন।
২. ইলাহি বিধিবিধান। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে সুবিন্যস্ত ও শৃঙ্খলিত করতেই এসব বিধান দেয়া হয়েছে। জিহারে বিধান, পালকপুত্র বিষয়ক বিধান, মিরাসের বিধান, পালকপুত্রের তালাক দেয়া স্ত্রীকে বিয়ে করার বিধান, রাসুলের একাধিক বিবি ও এ ব্যাপারে হেকমত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দুরূদ পাঠের বিধান, শরয়ি হিজাবের বিধান, ওলিমায় দাওয়াত দেয়া সম্পর্কিত বিধানসহ আরো কিছু শরয়ি বিধান আলোচিত হয়েছে।
৩. গযওয়া আহযাব ও গযওয়া বনু কুরায়জা সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা। এ দুই গযওয়া থেকে শিক্ষা ও নসিহত।
সূরাতু সাবা!
মূলবক্তব্য: উপেক্ষা ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে আল্লাহর অনুগ্রহ।
শিরকের মূলভিতকেই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন অস্বীকারকারী মুশরিকদের রদ করা হয়েছে। কয়েকজন রাসুলের কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমাস সালামের আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন রকমের নেয়ামত আল্লাহ তাদের অনুগত করে দিয়েছিলেন। কওমে সাবার কিসসা বর্ণিত হয়েছে। তারা সুখেশান্তিতে বাস করছিল। তাদের ছিল বাগবাগিচা। নদীনালা। তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করেছিল। আল্লাহ তাদের রাজ্যকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছেন। তাদেরকে অন্যদের জন্য শিক্ষার বিষয় বানিয়ে দিয়েছেন। খাতামুল মুরসালিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালত সম্পর্কে মুশরিকদের কিছু সন্দেহের কথা বলা হয়েছে। অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে তাদের সন্দেহ রদ করা হয়েছে। মুশরিকদেরকে এক পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আল্লাহরই হাতে সমস্ত সৃষ্টির সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ।
সূরাতুল ফাতির!
মূলবক্তব্য: আকিদার সর্ববৃহৎ বিষয়: আল্লাহর তাওহিদের দাওয়াত। আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ পেশ। শিরকের মূলনীতি সমূলে বিনাশ। কলবকে যাবতীয় মন্দস্বভাব থেকে মুক্ত করে, মহোত্তম আখলাক দ্বারা ভূষিত করার উৎসাহ।
শুরুতে বিশ^জগত সৃষ্টিকারী আল্লাহর কথা। তিনি ফিরিশতা, মানুষ, জি¦ন সৃষ্টি করেছেন। পুনর্জীবনের সপক্ষে এই দৃশ্যমান জগতে আল্লাহ তাআলা অসংখ্য দলিল তুলে ধরেছেন। মুমিন ও কাফেরের মাঝে বিরাট পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে। তাদের দুজনকে অন্ধ ও চক্ষুষ্মাণ, আলো ও আঁধার, ছায়া ও রোদের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কুরআন তিলাওয়াতকারী, সলাত কায়েমকারী, গোপনে ও প্রকাশে আল্লাহর দেয়া রিজিক থেকে দানকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। কুরআন পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানি কিতাবের সত্যয়নকারী। উম্মাহ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: জালেম, মধ্যপন্থী সৎকর্মশীল, কল্যাণকাজে তৎপর অগ্রগামী। প্রত্যেকের জন্য শেষদিনের প্রতিদান আছে। মূর্তিপূজার জন্য মুশরিকদের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের এহেন জঘন্য কাজের জন্য তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে।
সূরাতু ইয়াসিন!
মূলবক্তব্য: উসুলুদ্দীনের মৌীলকতম বিষয়গুলো বিশদ ও পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরা হয়েছে: রেসালত, ওহি, কুরআনের মুজিযা, নবিগণের সিফাত, তাকদির, আল্লাহর ইলম, হাশর, তাওহিদ, নেয়ামতদাতার শোকর ইত্যাদি। এগুলো বিশ^াস ও আমলের মাধ্যমে আনুগত্যের মূলনীতি। এসব থেকেই শরিয়তের বিধানসমূহ নির্গত হয়, ভালো ও মন্দ কাজের প্রতিদান সাব্যস্ত হয়। পাশাপাশি ব্যক্তি, জীবন ও জগত থেকে বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আকিদার সপক্ষে দলিলও দেয়া হয়েছে। এই সুরাকে কলবুল কুরআন বা কুরআনের হৃদপি- বলা হয়। কারণ, এই সুরায় আলোচিত বিষয়গুলোই পুরো কুরআনের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে আছে।
শুরুতে ওহির শুদ্ধতা ও রেসালতে মুহাম্মদির সত্যতার ওপর কুরআন কারিমের কসম খাওয়া হয়েছে। কাফের কুরায়শের আলোচনা করা হয়েছে। তারা গোমরাহিতে অনঢ় হয়ে ছিল। আল্লাহ তাদের ওপর আযাব অবধারিত করে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছেন। আসহাবে কারইয়াহ বা জনপদবাসীর কিসসা বলা হয়েছে। এ ঘটনা বলে, আল্লাহ ও রাসুলকে অস্বীকার করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। মুমিন দাঈর কথা বলা হয়েছে। তিনি আপন কাওমকে নসিহত করেছিলেন। কওম তাকে শহিদ করে দিয়েছিল। আল্লাহ তাকে জান্নাতে দাখিল করেছেন। আল্লাহ অপরাধীদেরও অবকাশ দেননি। এক বিকট আওয়াজ দ্বারা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আল্লাহ কুদরতের দলিল দেয়া হয়েছে। কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। পুনরুত্থান ও হিসাবের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত ঘটবেই, এ বিষয়ে দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
সূরাতুস সাফফাত!
মূলবক্তব্য: আকিদা ও তাওহিদের মূলনীতি, রেসালত, ওহি, পুনরুত্থান, প্রতিদান বিষয় আলোচনা পেশ করা হয়েছে।
ইবাদতের জন্য সফবন্দী ফিরিশতা ও মুসল্লিগণের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর এককত্বের দলিল দেয়া হয়েছে। শয়তানকে পাথর মেরে বিতাড়ন, জালিমদের লাঞ্ছিতকরণ, অনুগতদের জান্নাতে সম্মানদান, অপরাধীদের জাহান্নামে নিক্ষেপ, নুহের নিদর্শন, ইবরাহিমের আলোচনা, আনুগত্যের প্রতিদান প্রসঙ্গে ইসমাইলের কুরবানি, ইবরাহিমকে ইসহাকের সুসংবাদ, মুসা ও হারুনকে কিতাবদানের মাধ্যমে অনুগ্রহ, দাওয়াত দেয়ার সময় মানুষের অবস্থা, কওমে লুতের ধ্বংস, ইউনুসকে মাছের পেটে আটক বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। জিনদেরকে আল্লাহর সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জুড়ে দেয়া ও ফিরিশতাদেরকে ইবাদতের পর্যায়ে উঠিয়ে আনার ব্যাপারে মুশরিকদের ভ্রান্ত আকিদার অপনোদন করা হয়েছে। আল্লাহ নবিরাসুলকে সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছেন। আল্লাহ সমকক্ষ ও সমতুল্য বিপরীত শক্তির অস্তিত্ব থেকে পুরোপুরি মুক্ত।
সূরাতু সোয়াদ!
একজনরে
বাতিলের সাথে লড়াই ও তার পরিণতি ঘিরেই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। শুরুতে কাফেররা নবিজির নবুওয়াত নিয়ে অবিশ^াসমূলক বিস্ময় প্রকাশ করেছে। কাফেরদের দাবি, কুরআন মুহাম্মাদের বানোয়াট বাণী। আসমান ও জমিনের মালিকানা শুধুই আল্লাহর। বিচারদিবসের অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের প্রসঙ্গে দাউদ ও সুলাইমান আ.-এর কিসসা বর্ণিত হয়েছে। ইবতিলা-পরীক্ষা, আরোগ্য, বিপদমুক্তির প্রসঙ্গে আইয়ুব আ.-এর কিসসা তুলে ধরা হয়েছে। ইবরাহিম আ ও তার বংশ থেকে মনোনিত হওয়া নবিদেরকে বিশেষভাবে বাছাই করা হয়েছে। জান্নাতুল মাওয়ার অধিবাসীদের ঘটনা বলা হয়েছে। সাকার ও লাযা জাহান্নামে দুর্ভাগাদের দুর্দশাপূর্ণ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আদম-হাওয়া আ. ও ইবলিসের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর বিশেষ মনোনীত নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করার কারণে কাফেরদের প্রতি হুমকি। এই সুরায় বেশকিছু ঝগড়া-বিতর্কের কথা আছে। প্রথম বিতর্ক কাফেরদের সাথে নবিজির। তারপর দাউদ আ.-এর কাছে আসা দুই ব্যক্তির বিবাদ। জাহান্নামবাসীদের পারস্পরিক বিবাদ। মালায়ে আলা বা উর্ধজগতবাসীদের মতভিন্নতা। আদমের ব্যাপারে ইবলিসের বিবাদ। আদমসন্তান ও তাকে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে ইবলিসের বিবাদ।
সূরাতুয যুমার!
একনজরে
মূলবক্তব্য: তাওহিদ ও ইখলাসের দাওয়াত। শিরক প্রত্যাখ্যান।
শুরুতে কুরআন নাযিলের কথা বলা হয়েছে। দ্বীন ও ঈমানের ক্ষেত্রে ইখলাসের আলোচনা করা হয়েছে। মূর্তিপূজার ব্যাপারে কাফেরদের ভ্রান্ত অজুহাত তুলে ধরা হয়েছে। কোনও খুঁটি বা স্তম্ভ ছাড়াই বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আল্লাহ তাআলা আসমান সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ আসমান থেকে নেয়ামত বর্ষণ করে বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ করছেন। কোনও সাহায্য ছাড়াই আল্লাহ মায়েদের উদরে সন্তানকে হেফাজত করেন। কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার জন্য মানুষ উপযুক্ত প্রতিদান পাবে। রাতের আঁধারে রহমানের ইবাদতে মশগুল তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। সবরকারীদের প্রতিদান, ক্ষতিগ্রস্তদের লাঞ্ছনার কথা বলা হয়েছে। মুখলিস ও আল্লাহর মারেফাত হাসিলকারীদের জন্য জান্নাতে বাড়তি আবাসনব্যবস্থা থাকবে। মুমিনদের অন্তরকে তাওহিদ ও ঈমানের নুর দ্বারা আলোকিত করা হবে। সত্যবাদীদেরকে উত্তম প্রতিদান ও ক্ষমার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। মূর্তিসমূহ তাদের পূজারীদের কোনো সাহায্য করতে পারে না। সেগুলো পুরোপুরি অক্ষম ও অথর্ব। স্বপ্ন ও ঘুমের বিস্ময়কর বিষয়াবলী সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এক আল্লাহর কথা শোনার ব্যাপারে কাফেরদের বেজায় অনীহা। ঈমানদারদের জন্য আছে আল্লাহর রহমতের সুসংবাদ, অবাধ্যদের জন্য আছে ক্ষতি ও পরিতাপ। বিকট ও ভয়ংকর আওয়াজে শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। আল্লাহর সর্বময় কর্তৃত্ব দৃশ্যমান হবে। পরিপূর্ণ ইনসাফ কায়েম হবে। কাফেরদেরকে লাঞ্ছনা ও অপমানজনক পদ্ধতিতে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মুমিনগণ জান্নাতে সম্মানজনক বাসস্থানে আনন্দে থাকবে। সৃষ্টির মাঝে ইনসাফের সাথে ফয়সালা করা হবে। অনুগ্রহ ও এহসানকারী আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা।
সূরাতুল মুমিন-গাফের!
মূলবক্তব্য: হক ও বাতিল, হেদায়াত ও গোমরাহির লড়াই।
এজন্য সুরার ভাষাভঙ্গিতে তীব্রতা ও প্রচ-তার ছাপ পাওয়া যায়। আয়াতগুলোর আবহ দেখলে মনে হয় যেন যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে। তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা-তিরস্কার করা হয়েছে। অত্যাচারী সীমালঙ্ঘনকারীদের পরিণতি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাদের দম্ভ ও ক্ষমতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বান্দাদের প্রতি ক্ষমা দিয়ে অনুগ্রহ করেন, তাওবা কবুল করেন। আরশ বহনকারী ফিরিশতাগণের কথা বলা হয়েছে। কাফেররা জাহান্নামের তলদেশে কান্নাকাটি করবে। কেয়ামত দিবসে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা হবে। পূর্ববর্তী জালেম সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হয়েছে। অত্যাচারী ফেরাওনকে মুসা আলাইহিস সালাম দাওয়াত দেয়ার ঘটনা বর্ণনার মধ্য দিয়ে ঈমান ও অবাধ্যতার কিসসা বলা হয়েছে। ফেরাওন তার দাপট প্রতাপের সাহায্যে মুসা ও তার অনুসারীদের সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছিল। সে ভয় করেছিল, তার নিজের সম্প্রদায়ের মাঝে মুসার ঈমানি দাওয়াত ছড়িয়ে পড়বে। এই সুরায় মুসা ও ফেরাওনের ঘটনার এক নতুন দিক বেরিয়ে এসেছে, অন্য কোনো সুরায় এই প্রসঙ্গ নেই। তা হল, ফেরাওন পরিবার থেকে এক মুমিন ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ। এতদিন মানুষটা তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন। প্রথমে কোমল ও সতর্কভাবে পরে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীনভাবে ঈমানের কথা প্রকাশ করেছেন সাহসী মানুষটা। ফেরাওন সাঙ্গপাঙ্গসহ সাগরে ডুবে মরেছে। সেই দাঈসহ অন্য মুমিন মুক্তি পেয়েছেন।
আল্লাহর বড়ত্ব, মহিমা এককত্বের পরিচয়বাহী দৃশ্যমান জাগতিক কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। মিথ্যাচারী, অবাধ্য, সীমালঙ্ঘনকারী, দাম্ভিকদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহবিমুখ ও গাফেল থাকাবস্থায় তাদেরকে আল্লাহর আযাব এসে পাকড়াও করেছিল।
সূরাতু হামীম সাজদা!
মূলবক্তব্য: আকিদার হাকিকত বর্ণনা করা হয়েছে। তাওহিদুল উলুহিয়ত, শেষদিন, ওহি, রেসালত বিষয়ক আলোচনা তুলে ধরা হয়েছে। এটা করা হয়েছে, জাগতিক কিছু নিদর্শন, পূর্ববর্তীদের করুণ পরিণতি, কেয়ামতের কিছু দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে।
শুরুতে কুরআনের মর্যাদা ও গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। কাফেররা এই কুরআন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। আসমান ও জমিন সৃষ্টির পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইশারায় আদ ও সামুদ ধ্বংসের প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। কেয়ামতদিবসে অবাধ্যদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। কাফেররা জাহান্নামে বড় অসহায় ও অক্ষম অবস্থায় থাকবে। মুমিনগণকে স্থায়ী জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আযান দেয়া মুয়াজ্জিনগণ সম্মানের অধিকারী। শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। রহমানের এককত্বের ওপর দলিল পেশ করা হয়েছে। কুরআনের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে। লাভ-ক্ষতি, মন্দকর্ম ও সৎকর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে। ইবতিলা-পরীক্ষার সময় কাফেররা বড় অস্থির হয়ে পড়ে। রব্বে কারিমের কুদরতের পরিচয়বাহী নিদর্শন প্রকাশ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা প্রকাশ্য ও গোপন সমস্ত কিছুর জ্ঞান রাখেন।
সূরাতুশ শুরা!
মূলবক্তব্য: উম্মাহর ঐক্য আবশ্যক। শুরার গুরুত্ব।
তাওহিদের সপক্ষে দলিল পেশ করা হয়েছে। রাসুলের নবুয়ত ও ইসলামি শরিয়তকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেয়ামতের নিদর্শন প্রকাশ পাওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। দুনিয়া-আখেরাতে আমলকারীদের প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। রিজিক নির্ধারণ ও বণ্টনের হেকমত বর্ণনা করা হয়েছে। পাপের অকল্যাণকর দিক সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে। মানুষকে ক্ষমাকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। হিসাব নেয়ার সময় কাফেররা লাঞ্ছিত-অপদস্থ হবে। সন্তানদানের মাধ্যমে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। নবিগণের ওপর ওহি নাযিলের পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঈমান দান করে, রহমান তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সবকিছুর চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন এক আল্লাহর দিকে।
সূরাতুয যুখরুফ!
মূলবক্তব্য: দুনিয়ার ফিতনা ও তার চাকচিক্যের ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
শুরুতে কুরআনের সত্যতা প্রমাণ। উম্মি নবির ওপর এই কুরআন বিশুদ্ধতম ভাষায়, সুস্পষ্ট বর্ণনাভঙ্গিতে নাযিল করা হয়েছে। আসমান-জমিন, পাহাড়পর্বত, সাগর-নদী, সাগরে চলমান নৌযান, গোশত খাওয়া ও আরোহণযোগ্য মানুষের অনুগত গবাদিপশুতে আল্লাহর এককত্ব ও কুদরতের দলিল বিদ্যমান। জাহেলি যুগের কিছু কুসংস্কার, মূর্তিপূজা, কল্পকাহিনী বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। জাহেলি যুগের মানুষ কন্যাসন্তান অপছন্দ করত। অথচ আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান নির্ধারণ করত। এটা ছিল তাদের নির্বুদ্ধিতা ও নিছক অজ্ঞতা। তারা ফেরেশতাগনকে আল্লাহর কন্যা মনে করত। কুরআন তাদের এই ভ্রান্ত অমূলক ধারণ শুধরে দিয়েছে।
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দাওয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে। মক্কার মুশরিকরা মনে করত, তারা ইবরাহিমের বংশধর। তারা ইবরাহিমের ধর্মের ওপর অধিষ্ঠিত আছে। তাদের এহেন দাবিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করা হয়েছে। স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ইবরাহিমই সর্বপ্রথম মূর্তিপূজা থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। রিজিক বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামত দিবসে কাফেরদের অনুতাপ, অনুশোচনার কথা বলা হয়েছে। মুসা ও ফেরাওনের মুনাজারার কথা বলা হয়েছে। ফেরাওন চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ডুবে মরেছে। বিচারদিবসে তাওহিদের অনুসারীরা সম্মানিত হবে। কাফেররা অক্ষম অবস্থায় আযাবে নিমজ্জিত হবে। আসমান ও জমিনে প্রকৃত উলুহিয়ত আল্লাহর। রাসুলকে কাফেরদের উপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।
সূরাতুদ দুখান!
মূলবক্তব্য: দ্বীন অস্বীকারকারীদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতের আযাবের ভয় দেখিয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
কদরের রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। এই বরকতময় রাতের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। এই রাতে সৃষ্টির বিষয়াদি নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়। কুরআনের ব্যাপারে মুশরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। তারা কুরআনের ব্যাপারে ঘোরতর সন্দিহান। অথচ কুরআনের আয়াতসমূহ অত্যন্ত স্পষ্ট, দলিলগুলো অকাট্য ও সহজবোধ্য। মুশরিকদেরকে কঠিন আযাবের হুমকি দেয়া হয়েছে। কওমে ফেরাওনের কথা বলা হয়েছে। তাদের ওপর আযাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেমে এসেছিল। তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর, তাদের কীর্তি ও কর্মের নিদর্শন অবশিষ্ট থেকে গেছে। বাগবাগিচা, নদীনহর, প্রস্রবণ-ঝরনা-কূপ থেকে গেছে। বনি ইসরায়েল এসবের উত্তরাধিকারী হয়েছে। আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে, বনি ইসরায়েল এসব সুযোগসুবিধা থেকে বিতাড়িত হয়ে মিসর ছাড়া হয়েছে।
মক্কার মুশরিক কুরাইশ পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে। কুরাইশ পূর্ববর্তী অত্যাচারী ও দাম্ভিক-দাপুটে জাতিসমূহ থেকে তো আর বেশি শক্তিশালী নয়। আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। বেশি সম্মানিত নয়। অপরাধী অবাধ্য জাতিগোষ্ঠিকে ধ্বংসের ব্যাপারে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতিতে কখনো পরিবর্তন আসে না। শেষে পুণ্যবানদের অবস্থান ও পাপীদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে তরগিব ও তরহিব, তাবশির ও ইনজারের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে।
সূরাতুল জাসিয়া!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর কুদরত বর্ণনার মাধ্যমে, এককত্বের ওপর সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন।
কুরআন কারিমের কথা বলা হয়েছে। এই বিস্তৃত পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু জাগতিক আয়াতের কথা বলা হয়েছে। অপূর্ব অভিনব সৃষ্টি আসমানে নিদর্শন আছে। বিস্তৃত পৃথিবীতে নিদর্শন আছে। মানুষ, জীবজন্তু ও অন্যান্য মাখলুকের মাঝে নিদর্শন আছে। রাতদিনের আবর্তনে নিদর্শন আছে। বায়ু ও বৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে নিদর্শন আছে। প্রতিটি সৃষ্টিই আল্লাহর অপার কুদরত ও বড়ত্বের নিরব স্বাক্ষী।
তারপর কুরআন অস্বীকারকারী অপরাধীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। কুরআনের আলোকিত আয়াত শোনার পর তাদের অহংকার ও অবাধ্যতা আরো বেড়ে যায়। তাদেরকে জাহান্নামের তলদেশে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের ভয় দেখানো হয়েছে। বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অফুরন্ত নেয়ামত ঢেলে দিয়েছেন। যেন তারা শুকরিয়া আদায় করে, তাদের ওপর উপচে পড়া আল্লাহর নেয়ামত নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। আল্লাহ বনি ইসরায়েলকে নানা রকমের সম্মান, নেয়ামতে ভূষিত করেছিলেন। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণাকে কুফরি ও অবাধ্যতা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। সম্মানিত রাসুলগণের দাওয়াতের ব্যাপারে অপরাধী ও অবাধ্যদের অবস্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহর ইনসাফি মানদ-ে অপরাধী আর সৎকর্মশীল, পুণ্যবান আর দুষ্ট সমান নয়।
মুশরিকদের ভ্রষ্টতার কারণ বলা হয়েছে। তাদের নানাবিধ অপরাধ ও প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করার কারণে, তাদের অন্তর্দৃষ্টি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। হক-বাতিল পার্থক্য করার মানদ- অকার্যকর হয়ে গিয়েছিল। কেয়ামত দিবসে মানুষকে ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। সেদিন মানুষ দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যাবে: একদল জান্নাতে, আরেকদল জাহান্নামে।
সূরাতুল আহকাফ!
মূলবক্তব্য: ইসলামি আকিদার তিন মৌলিক বিষয় আলোচিত হয়েছে। তাওহিদ, রেসালত-ওহি, পুনরুত্থান ও প্রতিদান।
কুরআনের কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের পূজ্যপাদ মূর্তির কথা বলা হয়েছে। মুশরিকদের বিশ^াস, আল্লাহর পাশাপাশি এসব মূর্তিও তাদের উপাস্য। মূর্তিগুলো আল্লাহর কাছে তাদের সপক্ষে সুপারিশ করবে। যারা শোনে না, উপকার করতে পারে না, তাদের পূজা করা নিছক ভ্রষ্টতা। মুশরিকরা কুরআনের ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। সুস্পষ্ট ও অকাট্য দলিল তাদের এই চরম ভ্রান্ত বিশ^াস রদ করা হয়েছে।
হেদায়াত ও গোমরাহি হিসেবে দুই প্রকার মানুষের নুমনা পেশ করা হয়েছে,
প্রথম নমুনা: নেকসন্তান। সরল সঠিক ফিতরতের অধিকারী। মাতাপিতার প্রতি অনুগত ও সদাচারী। তার বয়েস যত বাড়ে তার তাকওয়া, সদাচারিতা, সততা, মাতাপিতার প্রতি এহসানও বাড়তে থাকে।
দ্বিতীয় নমুনা: বদ ও দুর্ভাগা সন্তান। ফিতরত বা জন্মগত স্বভাব থেকে বিচ্যুত। মাতাপিতার প্রতি দুর্ব্যবহারকারী ও অবাধ্য। ঈমান ও আখেরাতকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে।
উভয় সন্তানের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। হুদ ও সীমালঙ্ঘনকারী আদ জাতির কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। কওমে আদ পৃথিবীতে নৈরাজ্য কায়েম করেছিল। আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল। নিজেদের শক্তি-সামর্থ, দাপট-প্রতাপ দ্বারা ধোঁকা খেয়ে আত্মম্ভরি হয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তাদেরকে কল্যাণহীন বন্ধ্যা তীব্র বায়ু দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন। এই ধ্বংসের ঘটনা বলে মক্কার মুশরিক কুরাইশকে সতর্ক করা হয়েছিল। তারা আল্লাহর আদেশ পালনে অহংকার করেছিল। আল্লাহর রাসুলকে মানতে অস্বীকার করেছিল। শেষে একদল জিনের কিসসা বলা হয়েছে। তারা কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করে ঈমান এনেছিল। তারপর আপন কওমে গিয়ে মানুষকে সতর্ক করেছিল। ঈমানের দিকে দাওয়াত দিয়েছিল। জিনের ঘটনায় তখনো পর্যন্ত ঈমান না আনা মানুষের প্রতি সতর্কবার্তা ও উপদেশ ছিল। জিন হয়েও তাদের আগে ঈমান এনে ফেলেছে। তারা মানুষ হয়েও ঈমানে পিছিয়ে পড়েছে।
সূরাতু মুহাম্মাদ!
মূলবক্তব্য: কিতাল, বন্দী, গনিমতের বিধান ও মুনাফিকের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। মোটাদাগে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এই সুরার মূল আলোচ্যবিষয়।
আল্লাহ, তার রাসুল ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের শত্রুদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাফেররা রাসুলকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। রাসুলের দাওয়াতের প্রতিবন্ধক হয়েছিল। তারা মানুষকে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছিল।
মুমিনদেরকে কাফেরদের বিরুদ্ধে কিতালের হুকুম দেয়া হয়েছে। পৃথিবীকে কুফরের অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করতে, কাফেরদেরকে মুজাহিদের তরবারি দ্বারা প্রতিহত করতে বলা হয়েছে। পৃথিবীতে যেন কাফেরের কোনও ধরণের শক্তি-দাপট না থাকে। কাফেরদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদেরকে হত্যা ও জখম করার পর বন্দী করতে বলা হয়েছে। ইজ্জত ও সম্মানের পথ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মুমিন বান্দাকে আল্লাহ সাহায্য করার শর্তাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। শর্ত হল, আল্লাহর শরিয়ত আঁকড়ে ধরা ও আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করা।
মক্কার কাফেরদের উদ্দেশ্যে পূর্ববর্তী অত্যাচারী সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তারা অপরাধ ও সীমালঙ্ঘন করার পর, আল্লাহর তাদেরকে কীভাবে ধ্বংস করেছেন, সেটা বলা হয়েছে। মুনাফিকরদে বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য জঘন্য হুমকি। মানুষকে মুনাফিকের ধোঁকা-প্রতারণা, চক্রান্ত-কূটকৌশল থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, মুনাফিকের কুকীর্তি, বদখাসলত ফাঁস করে দেয়া হয়েছে। শেষে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের মাধ্যমে ইজ্জত ও বিজয়ের পথ আঁকড়ে ধরতে মুমিনদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। জীবন ও জীবিকার লোভে ইসলামের শত্রুদের সাথে আপস করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, নশ^র, ক্ষয়িষ্ণু। আল্লাহর কাছে যা আছে সেটা চিরস্থায়ী। অবিনশ^র।
সুরাতুল ফাতহ!
মূলবক্তব্য: হোদায়বিয়ার সন্ধি। ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুল ও মুশরিক কুরায়শের মাঝে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তি ফতহে মক্কা বা মক্কাবিজয়ের পথ তৈরি করেছিল।
মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আরবে মুসলমানদের বিজয়, সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পূর্ণতা পেয়েছিল। মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। মুমিনগণের জিহাদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাইআতে রিদওয়ানের কথা আছে। সাহাবায়ে কেরাম রাসুলের হাতে আমৃত্যু জিহাদের বাইআত দিয়েছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের জীবনে ও ইসলামের ইতিহাসে এই বাইআত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা এই বাইআতে অকল্পনীয় বরকত দান করেছিলেন। এতে অংশগ্রহণকারী সাহাবীদের প্রতি আল্লাহ ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তাদের কথা খোদ কুরআন কারিমে স্থান দিয়েছেন। ওহির নুরানি বাক্য দ্বারা তাদের এই মহাকীর্তি চিত্রিত করেছেন।
কিছু গ্রাম্য বেদুইন অন্তরের ব্যাধির কারণে রাসুলের সাথে হোদায়বিয়ার সফরে বের হয়নি। বেদুইনের মতো মুনাফিকরাও পিছিয়ে ছিল। তারা রাসুল ও মুমিনদের সম্পর্কে মন্দধারণাবশত এই সফরে বের হয়নি। তাদের মনের গোপন অভিসন্ধি ফাঁস করে তাদেরকে লাঞ্ছিত অপদস্থ করা হয়েছে। রাসুল বিজয়ের সুসংবাদবাহী স্বপ্ন দেখেছিলেন। নবিজি দেখেছিলেন, তিনি নিরাপদে নিশ্চিন্তে মক্কায় প্রবেশ করছেন। স্বপ্নটির বিবরণ জানতে পেরে, সাহাবায়ে কেরামকে ভীষণ আশাবাদী আর উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করা হয়েছে। তাদের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কেরামকে আপন রেজামন্দি দ্বারা সম্মানিত করেছেন। ইসলামের জন্য জিহাদ, সবর ও ত্যাগের কারণে তাদেরকে চিরস্থায়ী জান্নাত দ্বারা বিভূষিত করেছেন।
সূরাতুল হুজুরাত!
মূলবক্তব্য: ইসলামি সমাজের আখলাক সমুন্নত করা। মন্দস্বভাবের ব্যাপারে সতর্ক করা। সুরাটি আকারে ছোট হলেও, প্রকারে অনেক বড়। দ্বীন ও শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ চিরন্তন সব আদব-আখলাক বর্ণিত হয়েছে। তরবিয়ত ও সহবতের শাশ^ত নীতিমালা তুলে ধরা হয়েছে। নাগরিক জীবনের মৌলিক বিধি বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে হুজুরাতকে সুরাতুল আখলাকও বলা হয়।
শুরুতেই মুমিনদেরকে আল্লাহ, রাসুল ও শরিয়তের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও শরিয়তের চেয়ে আগে বাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। রাসুলের উপস্থিতিতে মুমিনগণ পাকাপোক্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না, আগে বেড়ে নিজস্ব কোনো মতামত জাহির করবে না, সামষ্টিক কোনো বিষয়ে ফয়সালা করবে না। আগে রাসুলের সাথে পরামর্শ করবে, রাসুলের প্রাজ্ঞ দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করবে।
রাসুলের সামনে কথাবার্তা বলার সময় স্বর উঁচু করবে না। রাসুলের সম্মান বজায় রাখবে। নবিজির অবস্থানের দিকে লক্ষ্য রাখবে। নবিজি ছাড়া অন্য বড়দের ক্ষেত্রেও এই আদব প্রযোজ্য। খাস-নির্দিষ্ট আদব বর্ণনার পর আম-উন্মুক্ত আদব বর্ণনা করা হয়েছে। গুজব-রটনার দিকে ভ্রƒক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা ও অনুসন্ধানের পন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। বিশেষ সংবাদটা যদি অনির্ভরযোগ্য, অনিরাপদ, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি থেকে ছড়ায়। নির্বিচারে গুজবে কান দেয়ার কারণে, মানুষ অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়। পারস্পরিক ফাটল-অনৈক্য সৃষ্টি হয়। দুই বিবদমান, ঝগুড়ে ব্যক্তির মাঝে আপস সৃষ্টি করে দিতে বলা হয়েছে। সীমালঙ্ঘনকারী, জালিমের জুলুম রোধ করতে বলা হয়েছে। অন্যকে উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, খোঁচা মারা, ছিদ্রান্বেষণ, কটাক্ষ করতে নিষেধ করা হয়েছে। গিবত ও দোষত্রুটি খোঁজার জন্য গোয়েন্দাগিরি করতে নিষেধ করা হয়েছে। অন্যের সম্পর্কে মন্দধারণা করতে নিষেধ করা হয়েছে। উম্মত আখলাখে ভূষিত হতে বলা হয়েছে। ঈমানি ভ্রাতৃত্বের মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন জাতিগোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিছু গাঁইয়া বেদুইন মনে করত, মৌখিকভাবে কালিমা পড়ার নাম ঈমান। ঈমানের হাকিকত স্পষ্ট করা হয়েছে। ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে। পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার শর্তাবলী বলা হয়েছে।
একনজরে কুরআন কারিম: ৪
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
--
সূরাতু ক্বাফ!
মূলবক্তব্য: পুনরুত্থান ও প্রতিদান দিবসের হাকিকত উপলব্ধির জন্য গাফেল কলব জাগিয়ে তোলা।
এই সুরা আবেগ ও অনুভূতির ওপর এক ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অন্তরকে কাঁপিয়ে তোলে। আত্মাকে নাড়িয়ে দেয়। এই সুরা তিলাওয়াতকারীর মনে গভীর বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ভীতির সঞ্চার করে। কারণ এই সুরার আয়াতে আয়াতে তরগিব ও তারহিব বিদ্যমান। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কথা বলা হয়েছে। ধ্বংসের পর পুনর্জীবনের কথা আছে। এই জগতের পরতে পরতে ছড়িয়ে জড়িয়ে থাকা আল্লাহ তাআলার অযুতনিযুত কুদরতের দিকে মুশরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। পূর্ববর্তী মিথ্যাচারী কওমের কথা বলা হয়েছে। তাদের ওপর নানাবিধ আসমানি আযাব ও দুর্যোগ নেমে এসেছিল। পূর্ববর্তী সম্প্রদায় ধ্বংসের কথা বলে মক্কার মুশরিক কুরায়শকে সতর্ক করা হয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণা ও হাশরের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই কঠিন দিনে অপরাধীরা ভয়ংকর গা শিউরানো পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
শেষে বলা হয়েছে, এক বিকট আওয়াজ হবে। সেই আওয়াজের তীব্রতায় মানুষ কবর থেকে উঠে যাবে। তাদেরকে হিসাব প্রতিদানের জন্য হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। মুশরিকরা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত। এই সুরায় কেয়ামতের অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। ঈমানের মৌলিক বিষয়াদি আলোচিত হয়েছে। সৃষ্টির সূচনা ও পুনর্জীবন সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাওহিদ, নবুয়ত, ফিরিশতার প্রতি ঈমানের কথা বলা হয়েছে। মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে: দুর্ভাগা ও সৌভাগ্যবান। আল্লাহর জন্য পূর্ণতম বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। তিনি মানুষের জন্ম ও মৃত্যুদাতা। তিনি মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। মানুষের মৃত্যু ও পুনর্জীবন সময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বড় বড় জমায়েতের সময় এই সুরা তিলাওয়াত করতেন। জুমার খুতবায়, দুই ঈদের নামাজে পড়তেন। ফজর নামাজেও পড়তেন।
সূরাতুয যারিয়াত!
মূলবক্তব্য: মাখলুককে তাদের খালেক ও রাজেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে তারা খালেকের দিকে ফিরে যেতে পারে। তার প্রতি দাসত্বের হক আদায় করতে পারে। পুরো সুরার আলোচনা ঈমানের স্তম্ভগুলোকে মজবুত করে তুলেছে। পরাক্রমশালী এক আল্লাহর কুদরতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাকওয়া ও ঈমানের ভিতের ওপর আকিদার পোক্ত সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
মৃত্যুর পর অবশ্যই একসময় পুনরুত্থানের ঘটনা ঘটবে। একথা কসম করে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেয়ামত ঘটবেই। পুনর্জীবন অবশ্যম্ভাবী। ভ্রষ্টদের জন্য আযাব অপেক্ষা করছে। হেদায়াত গ্রহণকারীদের জন্য আছে যথোপযুক্ত সওয়াব। কুরআনের চিরাচরিত ভঙ্গি-তরগিব ও তরহিব, ইনজার ও ইজার (অজুহাত গ্রহণের)-এর সাথে এসব কথা বলা হয়েছে। এই উন্মুক্ত বিস্তৃত বিশে^ আল্লাহর এককত্বের অফুরন্ত দলিল ছড়িয়ে আছে। মেহমানদারিতে ইবরাহিম আ. ছিলেন অনন্য মহত্বের অধিকারী। বৃদ্ধ বয়েসে ইবরাহিমকে ইসহাকের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আলাইহিমুস সালাম। কওমে লুতকে ধ্বংস করা হয়েছে। ফেরাওন ও তার সেনাবাহিনীকে আত্মধিকৃত অবস্থায় পাকড়াও করা হয়েছে। আদ, সামুদ ও কওমে নুহকে পুরোপুরি ধ্বংস বিধ্বস্ত করা হয়েছে।
শেষে জিন ও ইনসান সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর মারেফাত হাসিল করা, আল্লাহর এবাদত করা, একমাত্র আল্লাহকে উপাস্য রূপে গ্রহণ করার জন্যই এ দুই জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আল্লাহর নৈকট্যসূচক ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে একান্তভাবে আল্লাহর অভিমুখি হওয়ার সাধনায় মশগুল থাকা বান্দার কর্তব্য।
সূরাতুত তুর!
মূলবক্তব্য: বাতিলের প্রতিরোধ, মিথ্যাচারীদের অমূলক সন্দেহ অপনোদন।
সাইয়েদুল জিবাল-পাহাড়সমূহের নেতা ও সাইয়েদুল কুতুব-কিতাবসমূহের নেতার কসম দিয়ে সুরা শুরু হয়েছে। শুরুতে দুটি মহান নবুয়তের কথা আছে। তুর পাহাড় বলে মুসা আলাইহিস সালাম, কিতাব বলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা বলা হয়েছে। আখেরাতের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কাফেররা সেদিন যে ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কসম করে বলা হয়েছে, কাফেরদের ওপর আযাব নেমে আসা অবশ্যম্ভাবী। এটা কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না। জান্নাতে মুত্তাকিগণ সুখ-সাচ্ছন্দ্যে থাকবে। খাটিয়া ও আসনসমূহে হেলান দিয়ে মুখোমুখি হয়ে বসবে। আল্লাহ জান্নাতিদের জন্য নানা সুখশান্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। তাদের জন্য ডাগর চক্ষুবিশিষ্টা হুর থাকবে। সন্তান-সন্ততি পরিবেষ্টিত পূর্ণ নিশ্চিন্ত জীবন কাটবে। হরেক রকম পানাহারের আয়োজন থাকবে। নানাবিধ ফলমূল, ভোগবিলাস থাকবে। নানারকম সুস্বাদু রসনাবিলাসি গোশতসহ অগণিত সুখাদ্য থাকবে। এসব নেয়ামত দুনিয়ার কেউ কখনো চোখে দেখেনি, চেখে দেখেনি, কানে শোনেনি, কল্পনা করেনি। রাসুলকে উপদেশ দিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তাবলিগ করতে বলা হয়েছে। কাফেরদের সতর্ক করতে বলা হয়েছে।
অকাট্য দলিলের মাধ্যমে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালতের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। আল্লাহর উলুহিয়তের সত্যতার ওপর অকাট্য দলিল পেশ করা হয়েছে।
শেষে নবিজিকে আদেশ করা হয়েছে, কাফেরদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দিতে। তাদের কুকর্মে দুঃখিত না হতে। সতর্কবাণী কাফেরদের কোনো কাজে আসবে না। নবিজিকে সবরের আদেশ দেয়া হয়েছে। তাঁকে সাহায্য ও দৃঢ় সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। নবিজি সবসময় রবের শুকরিয়া আদায়ের আদেশ দেয়া হয়েছে।
সূরাতুন নাজম!
মূলবক্তব্য: ওহি ও রেসালত প্রমাণ করা হয়েছে।
মেরাজের আলোচনা দিয়ে সুরা শুরু হয়েছে। মেরাজ ছিল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজিযা। মেরাজের সফরে নবিজি আল্লাহর বিস্তৃত রাজত্বের অসংখ্য বিস্ময়কর ঘটনা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নবিজির দেখা এসব ঘটনা ছিল মানবকল্পনা ও মনুষ্য চিন্তাভাবনার অতীত। মেরাজ নিয়ে ভাবলে হতবুদ্ধি হয়ে যেতে হয়। মানুষকে ঈমান ও বিশ^াসের ব্যাপারে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। গাইব ও ওহি নিয়ে ঝগড়া-বিতর্ক পরিহার করতে বলা হয়েছে। দেবীমূর্তিদের কথা বলা হয়েছে। এসব ভ্রান্ত, অসার কাল্পনিক উপাস্যদের অক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিদান দিবসে সবাই ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান লাভ করবে। নেককার তার সৎকর্মের পুরস্কার পাবে। বদকার তার বদকর্মের কর্মফল ভোগ করবে।
প্রাণীকে জীবন ও মৃত্যুদানে, ধনী ও দরিদ্রকরণে আল্লাহর অপার কুদরতের জীবন্ত নিদর্শন জড়িয়ে আছে। নিষিক্ত হওয়া শুক্রবিন্দু থেকে আল্লাহ নারী ও পুরুষের জোড়া সৃষ্টি করেছেন। পূর্ববর্তী অত্যাচারী ও সীমালঙ্ঘনকারী কওমে আদ, সামুদ, কওমে নুহ, কওমে লুতের ওপর নানা রকমের আযাব ও ধ্বংস নেমে এসেছিল। এসব বলে মক্কার কাফেরদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের জন্যও এমন আযাব অপেক্ষা করছে। কারণ তারাও আল্লাহর রাসুলকে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সীমালঙ্ঘনকারীরা অবাধ্যতা ও হঠকারিতায় অনঢ় হয়ে আছে। এজন্য তাদেরকে ধমক দেয়া হয়েছে।
সূরাতুল কামার!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর আয়াতসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সতর্ক করা হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মিথ্যাচারীদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর আয়াত অস্বীকারকারীদের ওপর প্রচ- আঘাত হানা হয়েছে। এই সুরার বর্ণনাভঙ্গিটাই ভিন্ন। পুরো সুরায় হুমকি-ধমকি আর ইনজার-ইজার (অজুহাত গ্রহণ) মেশানো বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। নানাভাবে আযাব ও ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
মুশরিকরা আল্লাহর রাসুলের কাছে অলৌকিক ঘটনা দাবি করেছিল। তাহলে তারা রাসুলকে সত্য বলে মেনে নিবে। সেই প্রেক্ষিতে চন্দ্রখ-নের ঘটনা দিয়ে সুরা শুরু হয়েছে। মুশরিকরাই চাঁদকে দুই খ- করে দিতে বলেছিল। এতবড় মুজিযা দেখার পরও কুরায়শ ঈমান আনেনি। রাসুলকে সত্য বলে মেনে নেয়নি। উল্টো তাদের একগুঁয়েমী ও হঠকারিতা বেড়ে গিয়েছিল। গা-শিউরানো ভঙ্গিতে কেয়ামতের ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। সেদিনের ঘটনার বিবরণে ভয়ে যে কারো অন্তারাত্মা কেঁপে উঠবে। পূর্ববর্তী মিথ্যাচারীদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। তাদের ওপর হরেক রকমের আযাব নেমে এসেছিল। কুরাইশের কাফেরদের সম্বোধন করা হয়েছে। পূর্ববর্তী কওমসমূহের মতো তাদের ওপরও অনুরূপ আযাব নেমে আসার হুমকি দেয়া হয়েছে। অপরাধী দুর্ভাগা কাফেরদের দুরবস্থা বর্ণনার পর, সৌভাগ্যবান মুত্তাকিদের সুখময় পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
সূরাতুর রহমান!
মূলবক্তব্য: দুনিয়া আখেরাতে আল্লাহর নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর শোকর আদায়ের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করা বা নেয়ামত সম্পর্কে গাফেল থাকার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
শুরুতেই কুরআনের কথা। কুরআন রহমানের বড় নেয়ামত। রহমান দয়া করে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। বয়ান বা কথা বলতে শিখিয়েছেন। মিযান বা পাল্লার পরিমাপে ইনসাফ বজায় রাখতে বলা হয়েছে। আল্লাহ খোসাযুক্ত দানাশস্য ও রায়হান দান করেছেন। মানুষকে ঠনঠনা শুষ্ক মাটি থেকে বিস্ময়কর পদ্ধতিতে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সমুদ্র আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি। সমুদ্রে আছে আল্লাহর বিস্ময়কর কুদরতের নানা কারিশমা। সাগর থেকে বহুমূল্য প্রবাল ও মণিমুক্তা আহরিত হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠে আশ্চর্যজনক কুদরতে নৌযান ভেসে চলে। সমস্ত সৃষ্টি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র রহমান রহিম বাকি থাকবেন। অভাবগ্রস্তদের চাহিদা পূরণ করা হবে। হুজ্জত-প্রমাণ ছাড়া বান্দার মুক্তি নেই। যেদিনের ভয়ানক ধাক্কায় শিশুরা বৃদ্ধে পরিণত হবে, সেদিন আল্লাহর অনুগত ও অবাধ্য সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কাফের জাহান্নামে ডুবে মরবে, মুমিন সুখসম্ভারে মশগুল হবে। সৎকর্মশীলদের উত্তম বিনিময়ে ভূষিত করা হবে। ডাগরচোখা আনতনয়না হুর দেয়া হবে। মুত্তাকিগণ জান্নাতি বাগিচায় প্রমোদবিহার করবে। বান্দাকে নানাবিধ সম্মান ও নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন। আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা দিয়ে সুরা শেষ হয়েছে,
تَبٰرَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِی الْجَلٰلِ وَ الْاِكْرَامِ
বড় মহিয়ান তোমার প্রতিপালকের নাম, যিনি গৌরবময়, মহানুভব (রহমান: ৭৮)!
সূরাতুল ওয়াকিয়া!
মূলবক্তব্য: গুরুত্বের সাথে আকিদা রোপণ করা হয়েছে। আল্লাহর রুবুবিয়ত ও উলুহিয়তের দলিল পেশ করা হয়েছে। পুনর্জীবন ও প্রতিদানের প্রসঙ্গ দৃঢ় ভঙ্গিতে ব্যক্ত করা হয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী, জান্নাতি ও জাহান্নামি, দুনিয়াবাসী ও আখেরাতবাসীর সংবাদ দেয়া হয়েছে।
শুরু হয়েছে কেয়ামত সংঘটনের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে। সেদিন ভয়ংকর পরিস্থির সৃষ্টি হবে। মানুষ সেদিন তিনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে,
ক. আসহাবে ইয়ামিন।
খ. আসহাবে শিমাল।
গ. সৌভাগ্যবানদের স্তরে উন্নীত হওয়া সাবিকুন।
প্রতিটি দলের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদের জন্য উপযুক্ত ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন। আল্লাহর অস্তিত্ব, এককত্ব, পরিপূর্ণ কুদরত, অপূর্ব সৃষ্টিনৈপুণ্য, অভিনব কর্মকুশলতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। কুরআনের আলোচনা করা হয়েছে। কুরআন রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নাযিল করা কিতাব। মানুষ মৃত্যুর সময় যে ভয়ংকর কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তার চিত্র আঁকা হয়েছে। তিন প্রকার মানুষের বর্ণনা দিয়ে সুরা শেষ হয়েছে। সৌভাগ্যবান, দুর্ভাগা ও সুখভোগ ও সার্বিক কল্যাণের অধিকারী সাবিকুন (অগ্রগামী)। প্রত্যেকের পরিণতি ও পরিণাম বর্ণনা করা হয়েছে। সুরার শুরুতে যে আলোচনা সংক্ষিপ্ত ছিল, শেষে তা বিশদে বর্ণিত হয়েছে। শুরু ও শেষে নৈকট্যপ্রাপ্তদের কীর্তি আলোচনা করা হয়েছে।
সূরাতুল হাদীদ!
মূলবক্তব্য: ঈমান ও তার প্রভাব বিষয়ক আলোচনা। শরীয়ত, তরবিয়ত ও দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা গুরুত্ব পেয়েছে। ইসলামি সমাজকে বিশুদ্ধ আকিদা, উত্তম আখলাক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ শরিয়ার ওপর গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে। রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। তাদের আদর্শ অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুরো সুরায় মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে,
ক. পুরো বিশ^জগত আল্লাহর। তিনিই এই জগতের খালেক ও উদগাতা। আল্লাহ আপন ইচ্ছানুসারে এই জগত পরিচালনা করেন।
খ. আল্লাহর দ্বীনকে শক্তিশালী ও বিজয়ী করতে, ইসলামের পতাকা উড্ডীন করতে আপন জানমাল কুরবানি করা আবশ্যক। ইসলামের দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়েই আল্লাহ সর্বশেষ রাসুল পাঠিয়েছেন।
গ. দুনিয়ার হাকিকত তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়ার চাকচিক্য ও আড়ম্বর বড়ই ধোঁকাময়। মানুষ যেন দুনিয়ার ধোঁকায় পড়ে আখেরাত ভুলে না যায়। আখেরাতই প্রকৃত ও স্থায়ী আবাস। সেখানে কোনো কষ্ট নেই, ক্লান্তি নেই, দুশ্চিন্তা নেই, কষ্ট-দুর্ভোগ নেই।
সুরাতুল মুজাদালা!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর ইলম সর্বত্র, সর্বব্যাপী। আল্লাহ তাআলা সবকিছু দেখেন জানেন, শোনেন, বোঝেন। খাওলা বিনতে সালাবার ঘটনায় এ বিষয়টাই প্রকাশ পেয়েছে। স্বামী আওস বিন সামিত রা. তার সাথে জিহার করেছিলেন। খাওলা নবিজির কাছে এসে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন। পরোক্ষভাবে একথা বোঝানো হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বান্দাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। তাই আল্লাহবিরোধী কোনো আচরণ করার সময় বান্দার সতর্ক থাকা উচিত।
জিহারের বিধান ও তার কাফফারার বর্ণনা করা হয়েছে। ভর মজলিসে কানে কানে কথা বলার বিধান দেয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে এমন কাজ করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। নতুন কেউ মজলিসে এলে সরে বসে তাকে জায়গা করে দিতে বলা হয়েছে। আহলে ইলমের ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে। ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্ব করা, ইহুদিদের ভালোবাসা মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে। তারা ইহুদিদের কাছে মুমিনদের গোপন সংবাদ পাচার করত। মুনাফিকরা আল্লাহ ও রাসুলের সাথে শত্রুতা করত। আল্লাহকে মহব্বত করা ও আল্লাহর জন্য ঘৃণা করার হাকিকত বর্ণনা করা হয়েছে। এটাই ঈমানের মূল, দ্বীনের সুদৃঢ় হাতল। আল্লাহর দ্বীনে থাকতে হলে, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য ঘৃণার বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরী। এই সুরায় সূক্ষè একটি বিষয়ের দিকে ইশারা আছে। মানুষ কার কাছে নিজের গোপন কথা বলবে, দুঃখ-দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করবে, সেটা সতর্কতার সাথে নির্বাচন করা উচিত। আর নিজের সুখদুঃখের কথা বলার জন্য, আল্লাহ তাআলার চেয়ে উত্তম, বিশ^স্ত আর অন্তরঙ্গ আর কেউ হতে পারে না। তিনিই আমার গোপন কথা শুনবেন, যেভাবে খাওলার কথা শুনেছেন। এর আগে ইয়াকুব আ.-এর কথা শুনেছেন (ইউসুফ: ৮৬)।
সূরাতুল হাশর!
মূলবক্তব্য: গযওয়া বনু নজির। তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছিল। শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এ ঘটনায় আল্লাহর কুদরত প্রকাশ পেয়েছে। ইহুদিরা সুরক্ষিত দুর্গে বাস করত। তারা বিশ^াস করত, তাদের কেউ কিছু করতে পারবে না। আল্লাহর আযাব এমন দিক থেকে এল, তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ফাই ও গনিমতের বিধান বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করা হয়েছে। মুহাজিরদের ফজিলত ও আনসারের কীর্তি প্রকাশ করা হয়েছে। দুষ্ট মুনাফিকের কথা বলা হয়েছে। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদিদের সাথে যোগসাজশ করেছিল। তাদের সামনে ভয়ানক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। ঈমানদারদেরকে কেয়ামত দিবস সম্পর্কে নসিহত করা হয়েছে। ইনসাফ ও প্রতিদানের আখেরাতে সৌভাগ্যবানদের অবস্থান-মর্যাদা আর দুর্ভাগাদের অবস্থানে যোজন যোজন ফারাক থাকবে। আল্লাহর আসমায়ে হুসনা ও সমুচ্চ সিফাতের বর্ণনা করা হয়েছে।
সূরাতুল মুমতাহিনা!
মূলবক্তব্য: শরয়ি বিধানের দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও ঘৃণা করা এই সুরার মূলবিষয়। এটাই ঈমানের দৃঢ়তম হাতল। শুরুতে হাতেব বিন আবি বালতাআ রা.-কে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। নবিজি মক্কা অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই গোপন সংবাদ জানিয়ে হাতেব মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছিলেন। আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। তারা আল্লাহর রাসুল ও মুমিনদেরকে কষ্ট দিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে হিজরত করতে বাধ্য করেছিলে। ইবরাহিম আ. ও তাদের সাথিদের দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। তারা মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছিল। যুদ্ধ ও শান্তি, বন্ধুত্ব ও শত্রুতার সময় মুসলিম ও আহলে কিতাবের সম্পর্ক কেমন হবে, তার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। কুফরভূমি থেকে হিজরত করে আসা মুমিন নারীদের পরিক্ষা করে গ্রহণ করা আবশ্যক। হিজরত করে আসা নারীদের ঈমান প্রমাণিত হলে, তাদেরকে ফেরত পাঠানো যাবে না। তাদের কাফের স্বামীদের মোহরানা ফেরত দিতে হবে। রাসুলের কাছে নারীদের বায়আত নেয়ার বিধান ও শর্তাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। মুসলিম জাতির ঐক্যের নিমিত্তে, কাফেরদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
সূরাতুস সফ!
মূলবক্তব্য: দ্বীনের সাহায্যে এগিয়ে আসা।
আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ-কিতালের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনকে শক্তিশালী ও আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত রাখার জন্য কুরবানি করার কথা বলা হয়েছে। মুসা ও ঈসা আ.-এর দাওয়াতের প্রতিরোধে ইহুদিদের অবস্থান বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন, নবি ও ওলিদের সাহায্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর সুনান বা কর্মনীতির কথা বলা হয়েছে। ছোট্ট তুচ্ছ মুখে ফু দিয়ে সূর্যের আলো মুছে দিতে চাওয়া ব্যক্তির সাথে আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সংকল্পকারী মুশরিকদের দৃষ্টান্ত দেয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে লাভজনক ব্যবসার দিকে আহ্বান জানানো হয়েছে। স্থায়ী সৌভাগ্য লাভের জন্য, তাদেরকে জানমাল দিয়ে জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। জিহাদের ফলাফল বর্ণনা করা হয়েছে। তা হল, দুনিয়াতে বিজয় ও আখেরাতে জান্নাতলাভ। মুমিনদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। যেমনটা করেছিলেন, ঈসা আলাইহিস সালামের হাওয়ারিগণ। যখন তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল, তারা সানন্দে সাড়া দিয়েছিলেন ও জয়ী হয়েছিলেন।
সূরাতুল জুমুআ!
মূলবক্তব্য: এই উম্মাহর ফজিলত ও দ্বীন ইসলামের শেআর বা প্রতীক।
খাতামুল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণের আলোচনা করা হয়েছে। তিনি হেদায়াপ্রাপ্ত রহমত। তাঁর মাধ্যমে আল্লাহ আরব-আজমকে শিরকের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করে ইসলামের নুরের দিকে নিয়ে এসেছেন। ইহুদি ও আল্লাহর দেয়া শরিয়ত থেকে তাদের বিচ্যুতির কথা বলা হয়েছে। তাদেরকে গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে। গাধা পিঠে উপকারী কিতাব বহন করে, নিজে কিতাব থেকে উপকৃত হতে পারে না। কষ্ট আর ক্লান্তি শুধু তার প্রাপ্তি হয়। এটা চূড়ান্ত পর্যায়ের দুর্ভাগ্য আর লাঞ্ছনা। জুমার বিধান বলা হয়েছে। মুমিনগণকে দ্রুত জুমার দিকে ধাবিত হতে বলা হয়েছে। জুমার আযান হলে বেচাকেনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুনাফিকের মতো, ব্যবসাবাণিজ্য ও খেলাধূলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে সলাতের প্রতি উদাসীন হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। মুনাফিকরা অত্যন্ত হেলাভরে অলসতা নিয়ে সলাতে দাঁড়ায়।
সূরাতুল মুনাফিকুন!
মূলবক্তব্য: নিফাক ও মুনাফিকদের নিন্দা। তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ফাঁস। তাদের হীন-নিকৃষ্ট স্বভাবের ব্যাপারে মুমিনগণকে সতর্ক করা হয়েছে।
শুরুতে মুনাফিকদের হীন স্বভাব ও নিকৃষ্ট চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। তাদের সবকিছু মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ভেতরটা বাহিরের বিপরীত। তারা অন্তরে যা বিশ^াস করে, মুখে তার বিপরীতটা বলে। তারা রাসুল ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল। আল্লাহ তাদের অপরাধ ও ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে, তাদেরকে লাঞ্ছিত অপদস্থ করেছেন। তারা বাহ্যিক ও মৌখিকভাবে নিজেকে মুসলিম হিসেবে প্রকাশ করে, মানুষকে ইসলাম থেকে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করত। ইসলামের দাওয়াতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালাত। স্বঘোষিত কাফেরও এমনটা করতে পারত না। এজন্য মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলমানের জন্য চরম বিপদজনক। তাদের দিক থেকে আসা বিপদও কাফেরদের তুলনায় হাজারগুণ বেশি ভয়ংকর। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের ঘৃণিত উক্তি ও বিশ^াস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, নবিজির দাওয়াত অচিরেই বিলুপ্ত বিলীন হয়ে যাবে। তারা গাযওযা বনু মুস্তালিক থেকে ফেরার সময় বলেছিল, এবার মদিনায় ফিরেই আল্লাহর রাসুলকে মদিনা থেকে বহিষ্কার করে দিবে। এছাড়া ন্যাক্কারজনক আরো কথাবার্তা বলেছিল তারা। মুমিনগণকে মৃত্যু আসার আগেই, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, আখেরাতের জন্য সঞ্চয় করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সেদিন মানুষের আফসোসের সীমা থাকবে না। দুনিয়ার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত অনুতপ্ত হতে হবে। তখন আফসোস করে কোনো লাভ হবে না।
সূরাতুত তাগাবুন!
মূলবক্তব্য: ঈমান-আমলে ক্ষতি ও ক্ষতিগ্রস্তদের কথা বলা হয়েছে। ক্ষতির কারণ ও ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় বলা হয়েছে।
শুরুতে আল্লাহর বড়ত্ব ও মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে নেয়া মুমিন ও আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারকারী কাফের সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিগত যুগ ও সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। তারা আল্লাহর রাসুলগণকে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তাদের ওপর নেমে এসেছিল আল্লাহর আযাব ও শাস্তি। পুনরুত্থান অবশ্যম্ভাবী। আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্যের আদেশ দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো স্ত্রী ও সন্তানের শত্রুতার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। স্ত্রী-সন্তান অনেক সময় মানুষকে হিজরত ও জিহাদে বাধা সৃষ্টি করে। আল্লাহর রাস্তায় খরচ করতে বলা হয়েছে। কৃপণতার বাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য ব্যয়কারী সৎকর্মশীলদের জন্য দ্বিগুণ সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
সূরাতুত তালাক!
মূলবক্তব্য: তালাক ও তার আনুষঙ্গিক বিষয়। তালাক অনিবার্য হলে তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ও মেনে নেয়ার বিষয়ে আলোকপাত।
সুন্নতি তালাক ও বেদাতি তালাকের কথা বলা হয়েছে। দাম্পত্য জীবন চালিয়ে নেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালে, তালাকদানের ব্যাপারে মুমিনদেরকে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উপযুক্ত সময়ে, শরিয়তসম্মত পন্থায় তালাক দিতে বলা হয়েছে। পুরুষকে ধীরস্থিরতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। দাম্পত্য সম্পর্কটা ভেঙে ফেলতে তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। তালাক আল্লাহর কাছে ঘৃণিত হালাল হিসেবে বিবেচিত। তালাকের পর গুরুত্ব দিয়ে ইদ্দতকাল গণনা করতে বলা হয়েছে। যাতে একজনের বংশ আরেকজনের সাথে মিশে যাওয়ার আশংকা না থাকে আর তালাকপ্রাপ্তাকেও বেশিদিন বিয়েহীন অবস্থায় থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। হায়েজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নারী, অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে ও গর্ভবতী নারীর ইদ্দতকাল সম্পর্কে বলা হয়েছে। তালাকপ্রাপ্তার বাসস্থান, নাফাকা (খরচা) সম্পর্কে বলা হয়েছে। আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তাদের ওপর নেমে আসা আযাব ও ধ্বংস সম্পর্কে বলা হয়েছে। সাত আসমানকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি ও জমিন সৃষ্টিতে আল্লাহর কুদরতের কথা বলা হয়েছে। এসব আল্লাহর এককত্বের প্রমাণ বহন করে।
সূরাতুত তাহরিম!
মুসলিম পরিবার গঠন, প্রতিপালন ও সংশোনমূলক দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নবিগৃহ ও নবিপতœী উম্মাহাতুল মুমিনিন সম্পর্কিত কিছু বিধান আলোচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামি আদব-শিষ্টাচার আঁকড়ে ধরা সুখি মুসলিম পরিবার গঠনের রূপরেখাও পেশ করা হয়েছে। শুরুতে বলা হয়েছে, নবিজি অন্য স্ত্রীদের খুশি করতে, আপন বাঁদী মারিয়া কিবতিয়াকে নিজের ওপর হারাম করে নিয়েছিলেন। এজন্য সুরার শুরুতে নবিজির প্রতি মৃদু ভর্ৎসনা উচ্চারিত হয়েছে। তারপর পারিবারিক, পারস্পরিক, দাম্পত্য গোপনীয়তা ফাঁস করার মতো গুরুতর বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এমন কাজে দাম্পত্যজীবন হুমকির সম্মুখীন হয়। এ ব্যাপারে নবিজিকে দিয়ে দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তিনি হাফসা রা.-এর কাছে একটি গোপন কথা বলেছিলেন। হাফসা সেকথা আয়েশা রা.-এর কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা ওহির মাধ্যমে জানতে পেরে নবিজি রাগ করেছেন। এই ঘটনার জেরে নবিজি তার স্ত্রীদের তালাক দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। খোদ আল্লাহ তাআলা রাসুলের সমর্থনে উম্মাহাতুল মুমিনিনকে হুমকি দিয়েছেন। আল্লাহ তার রাসুলের জন্য বর্তমান স্ত্রীদের বদলে আরো ভালো স্ত্রী ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন। শেষে দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। মুমিন ব্যক্তির কাফের স্ত্রী, কাফের ব্যক্তির মুমিন স্ত্রীর দৃষ্টান্ত। আখেরাতে কেউ কারো কাজে আসবে না। নেক আমল না থাকলে, সেদিন বংশগোত্র কোনো কাজে আসবে না।
একনজরে কুরআন কারিম: ৫
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
--
সূরাতুল মুলক!
আল্লাহর রাজত্ব ও কর্তৃত্বের পূর্ণতার প্রকাশ ঘিরেই সুরা মুলকের আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। আল্লাহর ভয় জাগিয়ে তোলা হয়েছে। শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। আল্লাহর একত্বের দলিল, আল্লাহর কুদরত, বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের আলোচনা করা হয়েছে। এই বিশ^জগতে আল্লাহর সৃষ্টিনৈপুণ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কাফেরদের অবস্থা, কেয়ামতদিবসে মুমিনের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আসমান-জমিনের রাজত্ব-কর্তৃত্ব নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। মিথ্যাাচারীদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মারার জন্য, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সুস্পষ্ট অকাট্য যুক্তি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কুদরতের পূর্ণতা স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনার মাধ্যমে কুফর ও কাফেরের বিরুদ্ধে হুজ্জত কায়েম করা হয়েছে । সুরা মুলকের প্রধান তিনটি উদ্দেশ্য
ক. জীবন ও মৃত্যুদানে আল্লাহর পূর্ণ কুদরত ও বড়ত্ব প্রমাণ করা।
খ. আল্লাহর কুদরত ও একত্বের সপক্ষে সুস্পষ্ট আর উজ্জ্বল দলিল পেশ করা।
গ. মৃত্যুর পর পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান অস্বীকারকারী মিথ্যাচারীদের পরিণতি বর্ণনা করা।
সূরাতুল কলম!
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুয়ত সাব্যস্ত করা হয়েছে। নবিজির কলবকে আশ^স্ত করা হয়েছে। তিনটি মৌলিক বিষয় আলোচিত হয়েছে,
ক. রেসালত। আল্লাহর রাসুলের দাওয়াত সম্পর্কে মক্কাবাসীর উত্থাপিত সন্দেহ-অভিযোগ রদ করা হয়েছে। নবিজির মর্যাদা, মহোত্তম চরিত্র আর সুন্দর গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে।
খ. বাগানমালিকদের কিসসা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার কারণে তাদের ওপর নেমে আসা শাস্তির কথা আছে। বাগান মালিকরা ফকির-মিসকিনকে প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করেছিল। আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকারকারীদের পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।
গ. কেয়ামতের ভয়াবহতা, সেদিনের কঠিন পরিস্থিতির কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ মুসলিম ও মুজরিম (কাফের অপরাধী)-র জন্য কী প্রস্তুত করে রেখেছেন, সেটা বলা হয়েছে।
সূরাতুল হাক্কাহ!
চিন্তাভাবনা আর অনুধ্যান করে পড়লে, সুরা হাক্কাহ মনের ওপর গভীর রেখাপাত করে। কেয়ামতের ভয়াবহ বর্ণনা পড়ে গা শিউরানো ভয়ে শরীর ছমছম করে ওঠে। এই দ্বীন সবধরণের মিথ্যা-সন্দেহমুক্ত সত্য দ্বীন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব সংবাদ দিয়েছেন, তার সবই অকাট্য সত্য। এই সুরার নাম থেকেই এটা বোঝা যায়। হাক্কাহ-অবশ্যম্ভাবী অনিবার্য সত্য। বিগত কাফের ও মিথ্যাচারী সম্প্রদায়ের শোচনীয় পরিণতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে আদ, সামুদ, কওমে লুত, ফেরাওন, কওমে নুহসহ অন্যান সীমালঙ্ঘনকারী, উদ্ধত, পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কওমের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। সেই ভয়ংকর দিনে সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগাদের অবস্থা চিত্রিত করা হয়েছে। সেদিন মুমিনকে ডানহাতে আমলনামা দেয়া হবে। মুমিন সম্মান ও অনুগ্রহ লাভ করবে। কাফেরকে বামহাতে আমলনামা দেয়া হবে। কাফের সেদিন লাঞ্ছনা-গঞ্জনার সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এদিনের ভয়াবহতার প্রচ- ভীতি জাগানিয়া মানসিক চাপ শিশুকে শুভ্রচুলা বৃদ্ধ বানিয়ে দিবে। কুরআনের সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। কুরআন প্রজ্ঞাময় সর্বজ্ঞের কালাম। কাফেররা বলেছিল, মুহাম্মাদ নিজে রচনা বানিয়ে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে। নবিজিকে এই অপবাদ থেকে মুক্ত করা হয়েছে।
সূরাতুল মাআরিজ!
মক্কার কাফের ও তাদের মৃত্যুপরবর্তী পুনর্জীবন অস্বীকারের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। তারা রাসুলের দাওয়াত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ-উপহাস করত। কেয়ামত দিবস ও তার ভয়াবহতার কথা আছে। সেদিন কেউ সৌভাগ্যবান হবে, কেউ দুর্ভাগা হবে। কেউ আরামে থাকবে, কেউ কষ্ট-ক্লান্তিতে। মুমিনদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। মুমিনদের কিছু চমৎকার গুণাবলী আর উত্তম আখলাকের ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে। কেয়ামত দিবসে তাদের জন্য আল্লাহ বিরাট প্রতিদান ও সওয়াব প্রস্তুত করে রেখেছেন। জান্নাতে প্রবেশের প্রত্যাশী অপরাধী কাফেরের অবস্থাও তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন, জাহান্নামের আগুনের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। মাআরিজ মানে উর্ধারোহণের সিঁড়ি। সুরা মাআরিজে জমিনে বাস করা মানবাত্মাকে যেন আহ্বান জানানো হয়েছে, মাটির নিচুতা থেকে নিজেকে আসমানি উচ্চতায় উঠিয়ে নিতে।
সূরাতু নুহ!
আল্লাহর দিকে দাওয়াতে মরণপণ চেষ্টা কথা বলা হয়েছে। নুহ আ.-এর দাওয়াতের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পুরো দাওয়াতি সফরে তিনি যে অবিশ^াস্য সবর, মুজাহাদা ও আত্মত্যাগ স্বীকার করে গেছেন, তা সংক্ষেপে বলা হয়েছে। তিনি দিনরাত তার কওমের পেছনে দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত করে গেছেন। গোপনে ও প্রকাশ্যে। তিনি যত দাওয়াত বৃদ্ধি করেছেন, তার কওমের কুফরি, হঠকারিতা, অবাধ্যতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘ দাওয়াতেও তাদের মন নরম হয়নি। নসিহত-উপদেশও তাদের কানে প্রবেশ করেনি। শেষে সর্বব্যাপী প্লাবনের কথা বলা হয়েছে। নুহ তার কওমের জন্য বদদোয়া করেছিলেন। আল্লাহ মিথ্যাচারী কাফের কওমে নুহকে ডুবিয়ে মেরেছেন। আল্লাহর দাওয়াত গ্রহণে অনীহ ও সত্যচ্যুত কওমের ক্ষেত্রে এটাই আল্লাহর সুন্নাহ বা কর্মপদ্ধতি। যুগে যুগে বিভিন্ন কওমে ওপর আল্লাহর এই সুন্নাহ বাস্তবায়িত হয়েছে। প্লাবনের ঘটনায় প্রেরিত নবিগণের উত্তম পরিণতি আর মিথ্যাচারী অপরাধী সম্প্রদায়ের অন্তিম অবস্থা ফুটে উঠেছে। সর্বকালের দাঈদের জন্যও অমূল শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহর রাস্তার দাঈকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যয় করতে হয়। বিন্দুমাত্র বিরক্ত অসহিষ্ণু না হয়ে একটানা, অনবরত মেহনত চালিয়ে যেতে হয়। দাওয়াতি কৌশলেও নিত্যনতুন পন্থা অবলম্বন করতে হয়।
সূরাতুল জিন!
জিনদের কথাই প্রধানত আলোচিত হয়েছে। একদল জিন নবিজির তিলাওয়াত শুনে কাছে এসেছিল। কুরআন শুনে মুগ্ধ হয়ে ঈমান এনেছিল। জিনদের কিছু বিস্ময়কর অজানা সংবাদ দেয়া হয়েছে। মানুষের মতো জিনদের মধ্যেও ভালো ও মন্দ আছে। তারা গাইব জানে না। আমলের জন্য তারাও পুরষ্কৃত ও তিরস্কৃত হবে। তারা নিজের ইচ্ছায় কারো উপকার-অপকার করতে পারে না। তারাও মানুষের মতো পরিপূর্ণ আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। আল্লাহর কুদরত তাদের ওপরও পূর্ণ ক্রিয়াশীল। আল্লাহ তাআলার কিছু চির-অপরিবর্তনীয় সুন্নাহ বা কর্মপন্থার কথা বলা হয়েছে। যারা সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথের ওপর চলবে, দুনিয়া-আখেরাতে তারা উত্তম জীবন যাপন করবে। নবীজিকে মুশরিকদের মিথ্যাচার ও সন্দেহ অভিযোগের জবাব শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। মুশরিকদের নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতার বিপরীতে নবিজির জন্য সান্ত¡নাপ্রদ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যা নবিজির মনটাকে নির্ভার করেছে। দাওয়াত ও তাবলিগে সহায়ক হয়েছে।
সূরাতুল মুযাম্মিল!
কঠিন পরিস্থিতি ও জীবনে দুর্যোগময় অবস্থা মোকাবেলায় দাঈদের কী করণীয়, সুরাটিতে তার উত্তম পাথেয় আছে। নবিজীবনের কিছু টুকরো চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহর ইবাদতে নবিজির একাগ্র নিষ্ঠা, আল্লাহর প্রতি নবিজির আনুগত্য, সবর, জিহাদ, তাহাজ্জুদ, কুরআন তিলাওয়াতের কথা বলা হয়েছে। রাসুলের দাওয়াতের প্রতি মুশরিকদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে। নবিজি মুশরিকদের কাছে কল্যাণ ও হেদায়াত নিয়ে এসেছিলেন। মুশরিকরা হেদায়াত গ্রহণ না করে, নবিজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, নবিজিকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে, নবিজির দাওয়াতকে রুখে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। মুশরিকদের শিক্ষার জন্য অত্যাচারী ফেরাওনের দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। তার ধ্বংসাত্মক পরিণতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। মুশরিকরা সতর্ক না হলে, তাদেরও অবস্থাও ফেরাওনের মতো হবে। আল্লাহর রাসুল ও সাহাবায়ে কেরাম যাতে জীবন ও জীবিকার পেছনে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারেন, এজন্য আল্লাহ তাআলা দয়া করে, নবিজি ও মুমিনদের ওপর থেকে তাহাজ্জুদ আদায়ের দায়িত্ব হালকা করে দিয়েছেন।
সূরাতুল মুদ্দাসসির!
দাওয়াতি মেহনতে চেষ্টা-মুজাহাদা-অধ্যবসায়কে ঘিরে এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। শুরুতেই আল্লাহর রাসুলের কাঁধে দাওয়াতের দায়িত্ব কাঁধে তুলে দেয়া হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলিগের দায়িত্ব উদ্যম ও আন্তরিকতার সাথে করার তাকিদ দেয়া হয়েছে। কাফেরদের সতর্ক করতে বলা হয়েছে। তাদের কষ্ট-নির্যাতনে সবর করতে বলা হয়েছে। একসময় আল্লাহই রাসুল ও তার শত্রুদের ফয়সালা করবেন। অপরাধীদের হুমকি দেয়া হয়েছে। তাদেরকে এক কঠিন দিবসের ভয় দেখানো হয়েছে। দুর্ভাগা পাপী ওলিদ বিন মুগিরার কিসসা বর্ণনা করা হয়েছে। সে কুরআন শুনে বুঝতে পেরেছিল, এটা রহমানের কালাম। কিন্তু নেতৃত্বের মোহে, কর্তৃত্বের লোভে কুরআনকে চিরাচরিত জাদু আখ্যা দিয়েছিল। জাহান্নামের চিত্র এঁকে কাফেরদের ভয় দেখানো হয়েছে। জাহান্নামের কঠোর নির্দয় প্রহরীর কথা বলা হয়েছে। জাহান্নামিদের শাস্তি দেয়ার দায়িত্ব তাদের কাঁধে ন্যস্ত। জাহান্নামের প্রহরীদের সংখ্যা বলা হয়েছে। প্রহরিদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করার হেকমত বলা হয়েছে। মুশরিকরা কেন ঈমান উপেক্ষা করে, তার কারণ বলা হয়েছে।
সূরাতুল কিয়ামাহ!
পুনর্জীবন ও প্রতিদানকে ঘিরেই এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। পুনর্জীবন ও পুনরুত্থান ঈমানের অন্যতম রুকনও বটে। কেয়ামত ও তার ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে। সেদিন মানুষ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা। সৌভাগ্যবানদের চেহারা হবে উজ্জ্বল। তারা প্রিয় রবের দিকে তাকানোর দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করবে। দুর্ভাগাদের চেহারা হবে নিষ্প্রভ, মলিন, কালিমালিপ্ত, বিষন্ন, অন্ধকার। মৃত্যুর সময় মানুষের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। তখন মানুষ এমন কষ্ট আর যন্ত্রণার মুখোমুখি হবে, যা তার কল্পনাতেও ছিল না। হাশর, কেয়ামত, পুনর্জীবনের সত্যতা প্রমাণে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে।
সূরাতুদ দাহর!
শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষকে তার শ্রেষ্ঠতম লক্ষ জান্নাতের ব্যাপারে সজাগ করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরো সুরায় সামষ্টিকভাবে আল্লাহর আনুগত্য, আল্লাহর কাছে আশ্রয় গ্রহণ, আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা, আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করিয়ে দেয়া, আল্লাহর অনুগ্রহের অনুভূতি জাগ্রত করা, আল্লাহর আযাবকে ভয় করে বেঁচে থাকার চেষ্টা, আল্লাহর দেয়া পরীক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা, আল্লাহর সৃষ্টি, নেয়ামত ও অবকাশ দানের হেকমত উপলব্ধির দিকে সূক্ষè কোমল আহ্বান জানানো হয়েছে।
আলোচনা শুরু হয়েছে, মানুষকে স্তরে স্তরে, ধাপে ধাপে সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর কুদরত ও ক্ষমতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রস্তুত করেছেন ইবাদতের জন্য। মানুষকে সৃষ্টির প্রধানতম উদ্দেশ্যই হল আল্লাহর ইবাদত। আল্লাহ তাআলা মানুষকে চোখ-কান ও ইন্দ্রিয়শক্তি দিয়েছেন। জান্নাতিদের জন্য প্রস্তুতকৃত নেয়ামত, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্রের কথা বলা হয়েছে। সেইসব সৌভাগ্যবান জান্নাতিদের কিছু সিফাত-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তারা নজর-মানত পূর্ণকারী, রবের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় আহার দানকারী ইত্যাদি গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর কাছে (জান্নাতে) মুমিনদের জন্য যে সম্মান ও প্রতিদান আছে, তার কথা বলা হয়েছে। প্রতিদান দিবসে আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ আর নেয়ামত দান বর্ষণ করবেন। পানাহার, পোষাক-পরিচ্ছদ, খাদেম-সেবক ইত্যাদি নিয়ে জান্নাতিগণ কেমন সুখে থাকবেন, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সচেতন সজাগ কলবের অধিকারীর জন্য কুরআন জীবন্ত উপদেশ। সত্যসন্ধানী চিন্তার অধিকারীর জন্য কুরআন এক উজ্জল আলোকমালা।
সূরাতুল মুরসালাত!
এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে কেয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামকে ঘিরে। কেয়ামতের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। মিথ্যাচারী কাফেরকে এদিনের অবর্ণনীয় কষ্ট, দুঃসহ যন্ত্রণা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। কেয়ামত দিবসে শীতলতা, শান্তিময়তা, ছায়া মুত্তাকিদের জড়িয়ে রাখবে। এসব ভয় ও আশার চিত্র আঁকা হয়েছে জ্ঞানী, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের জন্য উপদেশ স্বরূপ। জালেম, দুষ্টদের সতর্কতার জন্য। কেয়ামত যে নিশ্চিতভাবে ঘটবেই, সুরার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে যুক্তি-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমে কয়েক শ্রেণীর ফেরেশতার কসম দেয়া হয়েছে। বিশ^জগতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনার দায়িত্বভার এই ফেরেশতাগণের কাঁধে ন্যস্ত। কসম খেয়ে বোঝানো হয়েছে, কেয়ামত সত্য, ধ্বংস ও আযাব কাফেরের ওপর পতিত হবে। অপরাধীদের ওপর প্রতিশ্রুত আযাব কখন আসবে, তার সময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুর পর মানুষকে পুনর্জীবিত করা, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মানুষকে নতুন করে সৃষ্টি করার ব্যাপারে আল্লাহর যে নিরংকুশ ক্ষমতা আছে, তার সপক্ষে দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। অপরাধীদের পরিণতির চিত্র আঁকা হয়েছে। তারা যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ভোগ করবে তার কথা বলা হয়েছে। মুমিনদের প্রত্যাবর্তনস্থলের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য সম্মান, নেয়ামত, সুখ-সাচ্ছন্দ্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। সবশেষে কাফেররা এক আল্লাহর ইবাদত কেন করে না, তার কারণ বলা হয়েছে।
সূরাতুন নাবা!
দলিল- প্রমাণের মাধ্যমে পুনর্জীবন ও প্রতিদান প্রমাণ করা নিয়েই এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। শুরুতে কেয়াত ও মৃত্যু পরবর্তী পুনর্জীবন সম্পর্কে সংবাদ দেয়া হয়েছে। এই বিষয়টাই মক্কায় অনেক লোকের মাথায় ঝেঁকে বসেছিল। তারপর আল্লাহর কুদরতের সপক্ষে দলিল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। তারপর পুনর্জীবনের কথা বলা হয়েছে। পুনর্জীবনের সময় ও মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। তখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাইকে হিসাবের জন্য জড়ো করবেন। জাহান্নামের কথা বলা হয়েছে। কাফেরদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জাহান্নামে আছে নানা রকমের লাঞ্ছনাকর। মুত্তাকিদের কথা বলা হয়েছে। তাদের জন্য আল্লাহ নানাবিধ নেয়ামত প্রস্তুত রেখেছেন। শেষে কেয়ামতের ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে। সেদিন কাফের আযাব থেকে বাঁচার জন্য মাটি হয়ে যেতে চাইবে।
সূরাতুন নাযিআত!
এ সুরায় কেয়ামত ও তার ভয়াবহতা, মুত্তাকি ও মুজরিমের পরিণতি বিষয়ক আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে। পুণ্যবান ফিরিশতাগণের কসম দেয়া হয়েছে। তারা মুমিনের রূহ কোমল নরমভাবে কবজ করে। মুজরিম-অপরাধীর রূহ নির্মম রূঢ়তায় কবজ করেন। পুনর্জীবন, পুনরুত্থান অস্বীকারকারী মুশরিকের কথা বলা হয়েছে। সে ভয়াবহ দিনে অপরাধীদের অবস্থা কেমন হবে, তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দাম্ভিক প্রতাপশালী ফেরাওনের কথা বলা হয়েছে। সে নিজেকে রব বলে দাবি করেছিল। সে তার দম্ভ অবাধ্যতায় ঘোরতরভাবে লিপ্ত ছিল। আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাকে কওমসহ ডুবিয়ে মেরেছেন। মক্কাবাসীর অবাধ্যতার কথা বলা হয়েছে। তারা রাসুলের বিরুদ্ধে শয়তানি করেছিল। তাদেরকে স্মরন করিয়ে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর অনেক মাখলুক থেকেও দুর্বল। তাদেরকে ধ্বংস করা আল্লাহর কাছে কিছুই নয়। শেষে কেয়ামত ঘটার সময়কাল নিয়ে কথা হয়েছে। মুশরিকরা কেয়ামতকে অসম্ভব মনে করত। তারা কেয়ামত অস্বীকার করত। কেয়ামত ঘটার বিষয়টাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করত।
সূরাতু আবাসা!
মানবীয় মূল্যবোধ শুদ্ধ করা, মানুষের পদমর্যাদা ও ওজনের ইসলামি মূলনীতি বর্ণনাকে ঘিরেই এই সুরার আলোচ্য বিষয় আবর্তিত হয়েছে। মানুষের মূল্য নির্ধারিত হবে তার আমল ও আচরণ দ্বারা। আসমানি হেদায়াত অনুসরণের পরিমান দ্বারা। খাদিজা রা.-এর ফুফাত ভাই, অন্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা.-এর কিসসা দিয়ে। তিনি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসেছিলেন। ইলম শেখার জন্য। তিনি হাজির হয়ে বারবার বলছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনাকে আল্লাহ যা শিখিয়েছেন, তা থেকে আমাকেও কিছু শেখান। আল্লাহর রাসুল তখন মক্কার বড় নেতাদের সাথে দাওয়াতি কাজ মশগুল ছিলেন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। বারবার ডাকায় বিরক্তিতে নবিজির কপাল কুঞ্চিত হয়েছিল। তখন মৃদু ভর্ৎসনামূলক আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ মানুষকে নেয়ামতে ডুবিয়ে রাখা সত্ত্বেও মানুষ আল্লাহর সাথে কুফরি করে। ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহর কুদরতের দলিল দেয়া হয়েছে। আল্লাহ সমতল ভূপৃষ্ঠে মানুষের জীবনযাপন সহজ করে দিয়েছেন। কেয়ামতের ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে। মানুষ সেদিন ভয়ের তীব্রতায় আপনজন থেকে পালাবে। সেই কঠিন দিনে মুমিন ও কাফেরের অবস্থা কেমন হবে, সেটা তুলে ধরা হয়েছে।
সূরাতুত তাকবির!
কেয়ামতের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুবিন্যস্ত সুশৃঙ্খল এই বিশ^জগত ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এই সুরায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাকিকত আলোচিত হয়েছে
ক. কেয়ামতের হাকিকত।
খ. ওহি ও রেসালতের হাকিকত।
উভয়টাই ঈমানের রোকন। ঈমানের পূর্ণতার জন্য উভয় হাকিকত জানা ও মানা আবশ্যক। শুরুত কেয়ামতের বর্ণনা। সেদিন পৃথিবীসব যাবতীয় বস্তু যে বিপুল ওলটপালটের মধ্য দিয়ে যাবে, সেটা বলা হয়েছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-সাগর, আসমান-জমিন, পশু-পাখি, জিন-ইনসান সবই ধ্বংসের আওতায় থাকবে। গোটা জগত প্রচ- কম্পনে প্রকম্পিত হবে। দীর্ঘ সময় ধরে এই কম্পন চলতে থাকবে। জগতের প্রতিটি বস্তুতে এই সম্পন ছড়িয়ে পড়বে। সেদিন বদলে যাবে সবকিছু। ওহির হাকিকত ও ওহি নাযিল হওয়া নবির সিফাত বর্ণিত হয়েছে। যাদের প্রতি ওহি নাযিল হয়েছে, ওহির প্রতি তাদের তুলে ধরা হয়েছে। ওহি নিয়ে আসা ফেরেশতার কথা বলা হয়েছে। যিনি শিরক ও গোমরাহির অন্ধকার থেকে ইলম ও ঈমানের আলোতে বের করার জন্য নেমে এসেছিলেন।
সূরাতুল ইনফিতার!
এই সুরার আলোচনা কেয়ামত দিবসের বর্ণনা ও মানবসৃষ্টির ক্ষেত্রে আল্লাহর কর্মকুশলতাকে ঘিরে ঘুরপাক খেয়েছে। প্রথমে কেয়ামত সংঘটনকালে মহাজাগতিক কিছু পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, গ্রহ-নক্ষত্র বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে, সাগর ফুলেফেঁপে উঠবে, কবরসমূহ উৎক্ষিপ্ত হবে। সবার হিসাবনিকাশ হবে হবে। যার যার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া হবে।
মানুষ স্বভাবগতভাবে অকৃতজ্ঞ। তার রবের নেয়ামত অস্বীকারকারী। মানুষ অনবরত তার রবের নেয়ামত গ্রহণ করে চলে, কিন্তু প্রাপ্ত নেয়ামতের হক আদায় করে না। নেয়ামতের যথাযথ মর্যাদা-কদর করে না। রবের মর্যাদা রক্ষা করে না। এত অনুগ্রহের পরও রবের শোকর আদায় করে না।
মানুষ কেন এমন অকৃতজ্ঞ তার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষের জন্য ফেরেশতা নিয়োগ করেছেন। নিয়োগকৃত ফেরেশতাগণ বান্দার সবকিছু লিখে রাখে। তার কর্মতৎপরতার প্রতি লক্ষ্য রাখে। আখেরাতে মানুষ দুই প্রকার। আবরার-পুণ্যবান। ফুজ্জার-পাপী। উভয় দলের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। পরিশেষে কেয়ামতদিবসের ভয়াবহতা আর প্রকা-তার কথা বলা হয়েছে। সেদিন মানুষ সব ধরণের শক্তি-সামর্থহীন থাকবে। সমস্ত ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব শুধু আল্লাহরই থাকবে।
সূরাতুল মুতাফফিফীন!
এই সুরার আলোচনা অর্থনৈতিক অপরাধ, মুসলমানদের অর্থনীতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকারীদের পরিণতিকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। ওজন-মাপে কম দেয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন ব্যক্তিরা আখেরাত ও শেষ বিচারের হিসাবকে ভয় করে না। আহকামুল হাকিমিন বা শ্রেষ্ঠতম বিচারকের মুখোমুখি হওয়ারও পরোয়া করে না।
দুর্ভাগা-পাপীদের কথা বলা হয়েছে। কেয়ামতদিবসে তাদের প্রতিদানের কথা বলা হয়েছে। তাদেরকে হুমকি-ধমকির সাথে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। মুত্তাকিদের আমলনামার কথা বলা হয়েছে। তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ ও সম্মান। সবশেষে মুমিন ও কাফেরের যৌথচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়াতে কাফেররা মুমিনদেরকে উপহাস করত। আখেরাতে ঘটবে তার উল্টোটা।
সূরাতুল ইনশিকাক!
কেয়ামত বিষয়ক আলোচনাই এই সুরায় ঘুরপাক খেয়েছে। শুরুতে আখেরাতের কিছু চিত্রদৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। কেয়ামতের সময় ঘটিতব্য মহাপরিবর্তনের কিছু চিত্র আঁকা হয়েছে। মানুষের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। মানুষ ইহজীবনে কষ্ট-পরিশ্রম করে। জীবিকা অন্বেষণে চেষ্টা-সংগ্রাম করে। দুনিয়াতে মানুষ ভালোমন্দ যাই করে, আখেরাতে তার ইনসাফপূর্ণ প্রতিদান পাবে। কুরআন সম্পর্কে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। কসম খেয়ে বলা হয়েছে, তারা একদিন ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। সেই ভয়াবহ দিনে সন্তান-সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। শেষে মুশরিকদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে। কারণ আল্লাহর নিদর্শন ও যুক্তি অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়া সত্বেও তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না। তাদেরকে জাহান্নামে যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সূরাতুল বুরূজ!
দ্বীনের ওপর অটল থাকাই এই সুরার মূল প্রতিপাদ্য। আসহাবে উখদুদের ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই কিসসাটিতে ঈমান ও আকিদার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়ার অপূর্ব নজির আছে। এই কিসসায় আছে বাতিলের সামনে অনঢ় অবিচল থাকার প্রেরণা। শুরুতে প্রকা-সব কক্ষপথবিশিষ্ট আকাশের শপথ। কেয়ামত দিবস, প্রেরিত ও সৃষ্টিকুলের শপথ করা হয়েছে। এতকিছুর শপথের পর, কাফেরদের ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। তারা একদল মুমিনকে আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে দিয়েছিল। তারা হুমকি-ধমকি আর নির্যাতনের মাধ্যমে মুমিনদেরকে দ্বীনচ্যুত করতে চেয়েছিল।
কাফেরদের ঘৃণিত কাজের জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শত্রু কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারে আল্লাহর কুদরতের কথা বলা হয়েছে। শেষে প্রতাপশালী ফেরাওন ও সামুদ জাতির কথা বলা হয়েছে। তাদের পাপ ও অবাধ্যতার কারণে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।
সূরাতুত তারিক!
এই সুরার আলোচনা আল্লাহর অপার কুদরতের কিছু প্রকাশ্য নিদর্শনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। উজ্জ্বল তারকাবিশিষ্ট আসমানের কসম খাওয়া হয়েছে। তারকাগুলো রাতের বেলা জ¦লজ¦ল করে। রাতের আঁধারে তারাগুলো জলেস্থলে পথিককে পথ দেখায়। আল্লাহ প্রতিটি মানুষের কসম খেয়েছেন। আল্লাহর প্রতিটি মানুষের জন্য জন্য পাহারাদার ফেরেশতা নিযুক্ত করেছেন। পুণ্যবান ফেরেশতা সবসময় মানুষের দেখাশোনা করে। আল্লাহর অসীম কুদরতের কথা বলা হয়েছে। তিনি সম্পূর্ণ ধ্বংস নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরও মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। কেয়ামতদিবসে মানুষের গোপন বিষয় প্রকাশ করা হবে। আখেরাতে মানুষের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। শেষে কুরআনের সত্যতার কথা বলা হয়েছে। কাফেরদেরকে আযাবের হুমকি দেয়া হয়েছে। কারণ তারা কুরআন অস্বীকার করত। কুরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করত।
সূরাতুল আলা!
মানুষকে সমুচ্চ আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া, মানুষকে দুনিয়া থেকে মুক্ত করে আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়াকে ঘিরেই এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। এই সুরায় মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে,
ক. আল্লাহ তাআলার সমুচ্চ সত্ত্বা। আল্লাহ তাআলার কিছু সিফাত। আল্লাহর কুদরত ও একত্বের ওপর কিছু দলিলপ্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
খ. ওহি ও কুরআন। যা সর্বশেষ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল হয়েছে। কুরআন হেফজ করা সহজ।
গ. উত্তম নসিহা। যা জীবন্ত হৃদয়ের অধিকারীদের জন্য উপকারী। সৌভাগ্যবান ঈমানদারগণ এই উপদেশ দ্বারা উপকৃত হতে পারে।
সূরাতুল গাশিয়া!
শেষদিন, আল্লাহর জন্য নিরংকুশ ক্ষমতা সাব্যস্তকরণকে ঘিরেই এই সুরার আলোচনা ঘুরপাক খেয়েছে। আলোচনাকে মৌলিকভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে,
ক. কেয়ামত দিবসের ভয়াবহ অবস্থা, সেদিন কাফেরদের দুরবস্থা আর মুমিনদের জন্য থাকবে সুব্যবস্থা।
খ. আল্লাহর একত্বের ওপর দলিল পেশ করা হয়েছে। উট, আসমান-জমিন, পাহাড় সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহর সুস্পষ্ট কুদরতের কথা বলা হয়েছে। এসব আল্লাহর একত্বের দলিল।
একনজরে কুরআন কারিম: ৬
কুরআন কারিমের সুরাগুলোর অতি সংক্ষিপ্ত নির্যাস। একবার পড়ে রাখতে পারি। রব্বে কারিম উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
.
সূরাতুল ফজর!
সুরায় মূলত বলা হয়েছে, কেয়ামতদিবসে কাফেরদের জন্য থাকবে আযাব। প্রধানত তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে,
ক. আল্লাহর প্রেরিত রাসুলকে অস্বীকারকারী কয়েকটি কওমের কথা বলা হয়েছে। কওমে আদ, কওমে সামুদ, কওমে ফেরাওন ইত্যাদি। পাপাচার ও অবাধ্যতার কারণে তাদের ওপর নেমে আসা আযাব ও ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে।
খ. ইহজীবনে আল্লাহ বান্দাকে ভালো ও মন্দ, প্রাচুর্য ও অভাব দ্বারা পরীক্ষা করেন। মানুষ স্বভাবগতভাগেই সম্পদের প্রতি প্রচ- লালায়িত।
গ. শেষদিনের ভয়াবহতার কথা বলা হয়েছে। সেদিন মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে-ভাগ্যবান ও দুর্ভাগা। দুষ্টমনের পরিণতি আর উত্তম মনের পরিণতির কথা বলা হয়েছে।
সূরাতুল বালাদ!
দুনিয়া কষ্ট ও পরীক্ষার জায়গা। এটাই এই সুরার মূলকথা। শুরুতে মক্কা, রাসুল সা, আদম ও আদমসন্তানকে সম্মান জানিয়ে কসম খাওয়া হয়েছে। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে কষ্ট-ক্লেশের মধ্য দিয়ে। জন্ম ও প্রসবের কষ্ট, দুনিয়ার নানা কষ্ট, আখেরাতে হিসাবের কষ্ট। কয়েকজন মুশরিককে রদ করা হয়েছে। তাদের মন্দকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে। তারা সন্তান ও সম্পদ নিয়ে বেজায় গর্ব করত। নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার ব্যাপারে অবহেলা করত। আল্লাহ তাদেরকে ইন্দ্রিয় দিয়েছিলেন, জবান, চিন্তাশক্তি ও সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। তারা এসবের কদর করেনি। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উৎকৃষ্ট পথ দেখানো হয়েছে। শেষে কাফেরকে হুমকি, মুমিনকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
সূরাতুশ শামস!
ইবাদত ও ভালকাজে উৎসাহ, আল্লাহর অবাধ্যতা ও মন্দকাজে সতর্কবার্তা দেয়াই এ সুরার মূলবার্তা। প্রধানত দুটি ধারায় সুরার আলোচনা বিভক্ত,
ক. মানবমন। আল্লাহ মানুষের মনকে ভালো ও মন্দ, হেদায়াত ও গোমরাহি গ্রহণের প্রবণতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।
খ. অবাধ্যতার কিসসা বলা হয়েছে। নমুনাস্বরূপ কওমের সালেহের কথা বলা হয়েছে। কওমে সামুদ আল্লাহর রাসুল সালেহ আ.-কে মানতে অস্বীকার করেছিল। আল্লাহর আইন লঙ্ঘন করেছিল। পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি ও নিদর্শন উটনীকে বধ করেছিল। উটনীটি ছিল আল্লাহর দেয়া মুজিযা। আল্লাহ তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করেছিলেন। তাদের ঘটনায় সবার জন্য জন্য শিক্ষা আছে। কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিটি কাফেরের জন্য সতর্কবার্তা। যারা নবিকে মানতে অস্বীকার করে, তাদের জন্যও।
সূরাতুল লাইল!
সাফল্য অর্জনের উপযোগী কিছু গুণাবলীর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ব্যর্থতা ডেকে আনে এমন কিছু বদ খাসলতের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। বান্দা ভালোমন্দ যা করতে চায়, আল্লাহর তার জন্য পথ সহজ করে দেন। মানুষের নানাবিধ চেষ্টা ও কর্মের কথা বলা হয়েছে। পার্থিব জীবনে মানুষের সংগ্রাম সাধনার কথা বলা হয়েছে। মানুষের অন্তিম পরিণতি হবে হয় জান্নাত না হয় জাহান্নাম। সুখ-সৌভাগ্যের পথ দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যের পথও। মুক্তিপ্রত্যাশীর জন্য সুস্পষ্ট পথরেখা এঁকে দেয়া হয়েছে। পুণ্যবান ও পাপী, জান্নাতি ও জাহান্নামির গুণাবলী-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিছু মানুষ নিজের সঞ্চিত ধন-সম্পদ দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সতর্ক থাকা কাম্য। রোজকেয়ামতে এসব পুঞ্জীভূত ধনৈশ^র্য কোনো কাজে আসবে না।
আল্লাহ বান্দাদের জন্য হেদায়াত ও গোমরাহির পথ স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বিশেষ হেকমতে একাজ করেছেন। মানুষকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব মক্কাবাসী আল্লাহর আয়াত ও রাসুলকে অস্বীকার করেছে, তাদেরকে আল্লাহর আজাব, প্রতিশোধ ও উত্তপ্ত আগুন সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। দুর্ভাগা কাফের এই অতি প্রজ্জলিত আগুনে প্রবেশ করবে। যে আল্লাহর দেয়া হেদায়াত ও আয়াত উপেক্ষা করেছে। শেষে মুমিনের কথা বলা হয়েছে। যিনি আত্মশুদ্ধির জন্য, নিজেকে আজাব থেকে বাঁচানোর জন্য ভালকাজে নিজ সম্পদ ব্যয় করেন। উদাহরণস্বরূপ আবু বকর রা.-এর কথা বলা হয়েছে। তিনি বেলাল রা.-কে ক্রয় করে আজাদ করে দিয়েছিলেন।
সূরাতুদ দুহা!
পেয়ারা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর নিবিড় তত্বাবধানই এই সুরার মূল প্রতিপাদ্য। রাসুলের ব্যক্তিত্ব নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। নবিজিকে তার শৈশবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি এতিম ছিলেন, গরিব ছিলেন, পথনির্দেশহীন ছিলেন। আল্লাহ তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। অভাব দূর করেছেন। যতœ করে প্রতিপালন করেছেন। আখেরাতে বিপুল পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ তার রাসুলের জন্য অকল্পনীয় সম্মান প্রস্তুত করে রেখেছেন। তার মধ্যে অন্যতম হল, কেয়ামত দিবসে শাফাআত। নবিজিকে উম্মতের জন্য সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। শেষে তিন নেয়ামতের বিনিময়ে তিনটি নসিহত করা হয়েছে। এতিমকে ¯েœহ, অভাবির প্রতি দয়া, দুঃস্থ-অসহায়ের সমস্যা দূর করার ওসিয়ত করা হয়েছে।
সূরাতুল ইনশিরাহ!
নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা আলোচিত হয়েছে। আল্লাহর কাছে নবিজির উচ্চ মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। ঈমান দ্বারা নবিজির বক্ষ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। হেকমত ও আল্লাহর মারেফত দ্বারা নবিজির কলব আলোকিত করে দেয়া হয়েছে। পাপ-পংকিলতা থেকে পবিত্র করা হয়েছে। শিঘ্রিই সংকট কেটে যাওয়ার আশ^াস দেয়া হয়েছে। শত্রুর বিরুদ্ধে আশু জয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। কঠিন অবস্থা সহজ করে দেয়া হবে। নবিজিকে জানানো হয়েছে, যিনি প্রথম থেকে নেয়ামত দিয়ে আসছেন, তার অনুগ্রহ কখনো বন্ধ হবে না। কাফেররা নবিজিকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল। এসব বলা হয়েছে নবিজিকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য। নবিজির মন ভালো করার জন্য। শেষে নবিজিকে দাওয়াতি কাজের অবসরে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এই এবাদত আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ।
সূরাতুত তীন!
মূলবক্তব্য: মানুষের প্রকৃত মূল্য ও সম্মান তার দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের অসম্মান, হীনতা দ্বীনহীনতায় নিহিত। শুরুতে পবিত্র স্থানের শপথ। যে স্থানকে আল্লাহ নবি-রাসুলের ওপর ওহি নাযিলের জন্য বিশেষায়িত করেছেন। স্থানগুলো হচ্ছে, বায়তুল মুকাদ্দাস, তুরপাহাড়, মক্কা মুকাররামা। শপথগুলো হয়েছে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা বোঝাতে। আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে, অপূর্ব আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ যদি তার রবের নেয়ামত ভোগ করে শোকর আদায় না করে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের নি¤œতম স্থানে ফেলবেন। আল্লাহ মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দলিল দেয়ার পরও আল্লাহ তাআলা এবং পুনরুত্থান অস্বীকার করার কারণে, কাফেরকে ভর্ৎসনা করা হয়েছে। শেষে আল্লাহর ইনসাফ প্রকাশ পেয়েছে। মুমিনের জন্য পুরস্কার আর কাফেরের জন্য শাস্তি।
আল্লাহ কি শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন? এই বাক্যটি পুরো সুরার নির্যাস মানে তাওহিদ, নবুয়ত ও পুনরুত্থানকে দৃঢ় সমর্থন করছে। । আল্লাহর হুকুমের কথা বলে আল্লাহর বিচার বা ইনসাফের কথা বলা হয়েছে। এই ইনসাফে কাফেরদের বিরুদ্ধে রাসুলকে সাহায্য করাও অন্তর্ভুক্ত।
সূরাতুল আলাক!
মূল বিষয়: প্রথম নাযিল হওয়া সুরা। ইলম ও ইলম শেখার গুরুত্ব ও মর্যাদা।
এই সুরায় প্রধানত তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে,
ক. খাতামুন নাবিয়্যিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ওহি নাযিলের সূচনা।
খ. সম্পদ নিয়ে মানুষের স্বেচ্ছাচার। আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে মানুষের অবাধ্যতা।
গ. এই উম্মতের ফেরাওন, অবাধ্য দুর্ভাগা আবু জাহলের কিসসা। সে রাসুলকে সলাতে বাধা দিয়েছিল। আবু জাহলের কুকীর্তি তুলে ধরা হয়েছে।
সূরাতুল কদর!
মুলকথা: লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব, বড়ত্ব ও মর্যাদা তুলে ধরা।
শুরুতে কুরআন নাযিলের কথা। লাইলাতুল কদর সম্মানিত হওয়ার একটি কারণ, এই রাতে কুরআন নাযিল হয়েছে। লাইলাতুল কদর সহ¯্রাধিক রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই রাতে আল্লাহর খাস রহমত, নুর ও হেদায়াত নাযিল হয়। আল্লাহ তার প্রিয় মুমিন বান্দাকে অনুগ্রহের চাদরে ঢেকে দেন। কুরআন নাযিলকে স্মরণীয় করে রাখতেই এতসব আয়োজন। এই রাতে পুণ্যবান ফেরেশতাগণ শান্তি ও রহমত নিয়ে নেমে আসেন। ফজর পর্যন্ত পৃথিবীতে অবস্থান করেন।
সূরাতুল বাইয়িনা!
মূলবক্তব্য: রাসুলের রেসালতের মর্যাদা। নবিজির রেসালত সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণ।
প্রধানত তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে,
ক. নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালত সম্পর্কে আহলে কিতাবের অবস্থান। তারা রাসুলের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। যখন হকবাণী নিয়ে রাসুল আগমন করলেন, তারা মানতে অস্বীকার করল।
খ. ইখলাস। এবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য।
গ. আখেরাতে সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগাদের পরিণতি।
সূরাতুয যিলযাল!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন। কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতার সংবাদ প্রদান। কেয়ামতের আলামত, সেদিন মানুষের ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা, আনুগত্যের পুরস্কার, পাপের শাস্তি, ইনসাফের পাল্লায় আমল পরিমাপের কথা বলা হয়েছে।
শুরুতে কেয়ামত দিবসের ভয়াবহতা, বিশেষ করে কেয়ামতের আগে ঘটিতব্য ভয়ংকর ভূমিকম্পের কথা বলা হয়েছে। তখন উঁচু উঁচু প্রাসাদ-স্থাপনা সব ধ্বসে যাবে। সুদৃঢ় পর্বতমালা গুঁড়িয়ে যাবে। অবিশ^াস্য বিস্ময়কর সব ঘটনা ঘটবে। সেসব দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়বে। জমিন তার গর্ভে থাকা মৃত লাশ ছুঁড়ে মারবে। মূল্যবান ধাতু, খনিজ পদার্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য উগড়ে দিবে। মানুষ দলে দলে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে। কেউ যাবে জান্নাতে, কেউ জাহান্নামে। মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে: সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা।
সূরাতুল আদিয়াত!
মূলবক্তব্য: মানুষের ধ্বংস ও ক্ষতির কারণ।
শুরুতে জিহাদের ঘোড়ার কসম খাওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে এই ঘোড়ার সম্মান ও গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কসম খেয়ে বলা হয়েছে: মানুষ আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ। চলাবলায় মানুষ সে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ্যে ঘোষণাও করে। মানুষের জন্মগত স্বভাবের কথা বলা হয়েছে। সম্পদের প্রতি মানুষের তীব্র লোভের কথা বলা হয়েছে
সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। শেষে বলা হয়েছে, মানুষকে সবশেষে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে। হিসাব ও প্রতিদানের জন্য। আখেরাতে সন্তান-সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। সেদিন শুধু ঈমান আর আমলে সালেহ কাজে আসবে।
সূরাতুল কারিয়া!
মূলবক্তব্য: প্রতিদান দিবসকে স্পষ্ট করে তোলা।
কেয়ামত দিবসের শুরু ও শেষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানুষকে দুই ভাবে বিভক্ত করা হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। কেয়ামত দিবসের ভয়াবহ অবস্থা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেদিন ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটবে। মানুষ কবর থেকে বের হয়ে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের মতো ছড়িয়ে পড়বে। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছোটাছুটি করতে থাকবে। প্রচ- ভয়ে ভীত হয়ে কী করবে, প্রথমে বুঝতে উঠতে পারবে না। মাটিতে দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকা অটল পাহাড়গুলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে রঙিন পেঁজা পশমের মতো আকাশে উড়তে শুরু করবে। মানুষ ও পাহাড়ের অবস্থা একসাথে বর্ণনা করা হয়েছে। সুবিশাল পাহাড়ের যদি এমন অবস্থা হয়, সেদিন ক্ষুদ্র মানুষের অবস্থা কেমন দাঁড়াবে?
শেষে মিযান বা দাঁড়িপাল্লার কথা বলা হয়েছে। সেদিন মানুষের আমল মাপা হবে। মাপ অনুযায়ী মানুষ দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়বে। সৌভাগ্যবান আর দুর্ভাগা। যার নেকআমলের পাল্লা ভারি হবে, সে সুখি। যার বদআমলের পাল্লা ভারী, সে দুঃখী।
সূরাতুত তাকাসুর!
মূলবক্তব্য: আখেরাত নিয়ে উদাসীনতার ব্যাপারে সতর্কীকরণ।
মানুষ দুনিয়ার মোহমায়া আর চাকচিক্যে বিভোর। দুনিয়ার তুচ্ছ লাভপ্রাপ্তি নিয়ে পরস্পর কামড়াকামড়িতে লিপ্ত। একসময় আচানক মৃত্যু এসে হানা দেয়। সুখের প্রাসাদ থেকে কবরে নিয়ে ফেলে। সুপরিসর পৃথিবী থেকে সংকীর্ণ মাটির কুঠুরিতে আবদ্ধ করে। মানুষ চিরস্থায়ী জীবন ছেড়ে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া নিয়ে ভীষণ মশগুল। তাই মানুষকে ভয় দেখানো আর ভুলের ব্যাপারে সচেতন করার জন্য বারবার ধমক আর সতর্কবার্তা উচ্চারিত হয়েছে। আখেরাতে কী কী বিপদ ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে, সেটার বর্ণনা আছে। সেদিন মুমিন ছাড়া আর কেউ এসব থেকে নিস্তার পাবে না। বাঁচতে হলে মৃত্যুর আগেই পরকালের জন্য আমলে সালেহ পাঠাতে হবে। জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ হিসেবে এই একটি সুরাই যথেষ্ট।
সূরাতুল আসর!
এই সুরাকে কুরআন কারিমের অন্যতম ব্যাপক অর্থবোধক সুরা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অত্যন্ত সংক্ষেপে এই সুরায় বহুকিছু বলে দেয়া হয়েছে। একেবারে সামান্য কয়েকটা কথায় মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কারণ স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এই দুনিয়াতে সাফল্য ও ব্যর্থতার সূত্র ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ শুরুতে আসর বা সময়ের কসম খেয়েছেন। মানুষের জীবনটা এই সময়েরই অংশ। সময়ই ধারণ করে নানা বিস্ময়কর ঘটনা, আল্লাহর কুদরত ও হেকমতের পরিচয়বাহী শিক্ষাবলী। কসম খেয়ে বলা হয়েছে, মানবজাতি ক্ষতির মাঝে আছে। চারটি গুণের অধিকারী ব্যক্তিই এই সমূহ ক্ষতি থেকে নিরাপদ: ঈমান, আমলে সালেহ, পরস্পর হকের উপদেশ, পরস্পর সবরের উপদেশ।
এই চারটি বৈশিষ্ট্য সমস্ত গুণের সমাহার। দ্বীনের মূলভিত। ইমাম শাফেয়ি রহ. বলেছেন: পুরো মানবজাতি যদি শুধু এই সুরা নিয়ে চিন্তাভাবনা করত, তাদের হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট হত। আরেক সালাফের মতে: এই সমস্ত উলুমে কুরআনের নির্যাস ধারণ করে আছে।
সূরাতুল হুমাযা!
মূলবক্তব্য: দ্বীন ও দ্বীনদারদের উপহাস করা ব্যক্তির প্রতি সতর্কবার্তা।
মানুষের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ানো ছিদ্রান্বেষণকারী, মানুষকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপকারী হীন নিচ লোকদের নিন্দা করা হয়েছে। তারপর নিন্দা করা হয়েছে সম্পদ-ঐশ^র্য জমিয়ে পুঞ্জীভুতকারীদের। তারা অকাট অজ্ঞতা আর ডাহা গাফলতবশত মনে করে, সম্পদ তাদেরকে দুনিয়াতে চিরঞ্জীব করে রাখবে। শেষে পূর্বোক্ত হতভাগা ব্যক্তিদের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। তারা চিরন্তন আগুনে প্রবেশ করবে। এই আগুন কখনো নিভবে না। এই আগুন অপরাধীদের পুড়িয়ে ছাই করে চুরচুর করে ফেলবে। এমন জাহান্নামের নাম হুতামা।
সূরাতুল ফীল!
মূলবক্তব্য: বায়তুল্লাহর সুরক্ষায় আল্লাহর অপার কুদরত।
আসহাবে ফিলের ঘটনা ছিল মানুষ বিশেষ করে মক্কাবাসীদের জন্য উপদেশ ও অনুগ্রহস্বরূপ। সুরায় আসহাবে ফিলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কাফের আবরাহা কাবা শরিফ ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল। আল্লাহ তার চক্রান্তকে মোক্ষমভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর নিজের ঘরকে হানাদারদের হাত থেকে অলৌকিক অথচ যুক্তিসঙ্গত উপায়ে রক্ষা করেছেন। আবরাহা আশরামের বিপুল হস্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে আল্লাহ তার খুদে দুর্বল এক পক্ষিবাহিনী পাঠিয়েছেন। পাখিগুলো চঞ্চু ও পায়ের নখে ছোট পাথর বহন করে এনেছিল। ক্ষুদ্র পাথরকণাই ধ্বংসাত্মক অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল। পুরো বাহিনীকে সমূলে বিনাশ করে দিয়েছিল। ইতিহাসের মোড় ঘোরানো এই ঘটনা ঘটেছিল নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মের বছর। নবিজির জন্মের আগে কিছু ঘটনা ঘটেছিল। এগুলোকে সিরাতের পরিভাষায় ইরহাসাত (إرهاصات) বলা হয়। এগুলোকে নবিজির সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আসহাবে ফিলের ঘটনাও অন্যতম ‘ইরহাসাত’।
কুরআন কারিমে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠি ধ্বংসের কথা একাধিকবার বর্ণিত হলেও, এই ঘটনা শুধু একবারই বর্ণিত হয়েছে। কারণ,
ক. আসহাবে ফিল ধ্বংসের ঘটনা আল্লাহর কোনো রাসুলকে অস্বীকার করার কারণে ঘটেনি।
খ. মক্কার মুশরিকরা যাতে অহংকারবশত এই ঘটনাকে নিজেদের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করতে না পারে। তারা যেন বলতে না পারে, আল্লাহর কাছে তাদের গুরুত্ব মর্যাদা অনেক বেশি বলেই আল্লাহ তাদেরকে আক্রমণ থেকে অলৌকিক উপায়ে রক্ষা করেছেন।
সূরাতু কুরাইশ!
মূলবক্তব্য: কুরায়শের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাদের করণীয়।
মক্কাবাসীর ওপর আল্লাহর খাস অনুগ্রহ ছিল। তারা বছরে দুটি ব্যবসায়িক সফরে বের হত। বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে শীতে ইয়ামান সফর, গ্রীষ্মে শাম সফরে বের হত। আল্লাহ কুরায়শকে দুটি বিশেষ নেয়ামতে ভূষিত করেছিলেন,
ক. শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা।
খ. ব্যবসায়িক সাফল্য ও প্রাচুর্য।
এসব স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছিল। অন্যসব ভ্রান্ত বাতিল উপাস্যদের বর্জন করতে বলা হয়েছিল। তারা মানেনি।
সূরাতুল মাউন!
মূলবক্তব্য: আল্লাহর হক ও বান্দার হক। হক্কুল্লাহ, হক্কুল ইবাদ।
এই সুরায় সংক্ষেপে দুই প্রকার মানুষের কথা বলা হয়েছে,
ক. কাফের। আপন রবের নেয়ামত অস্বীকারকারী। হিসাব ও প্রতিদান দিবস অস্বীকারকারী।
খ. মুনাফিক। যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করে না। লোকদেখানোর জন্য করে।
প্রথম দলের কিছু মন্দ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তারা এতিমকে অপমান করে। এতিমের সাথে ধমক দিয়ে কথা বলে। তারা এমনটা করে আদব শিক্ষা দেয়ার জন্য নয়; তাদের স্বভাবজাত রূঢ়তাবশত। তারা ভালো কাজ করে না। গরিব-মিসকিনের প্রাপ্যের কথা মনে করিয়ে দিলেও তারা দান-খয়রাত করে না। তারা খালেকের ইবাদতেও এহসান করেনি, খালক বা সৃষ্টির প্রতিও এহসান করেনি।
দ্বিতীয় দলে থাকা মুনাফিকরাও সলাতের ব্যাপারে উদাসীন ছিল। তারা সময়মতো সলাত আদায় করত না। কখনো বাহ্যিকভাবে নামাজে দাঁড়ালেও, সেটা করত লোকদেখানোর জন্য, আল্লাহর জন্য নয়।
উভয় দলকে ধ্বংসের হুমকি দেয়া হয়েছে। তাদের ন্যাক্কারজনক আচরণের তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের কৃতকর্মের জন্য চরম বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে।
ইবাদতে ইহসান মানে, এমনভাবে ইবাদত করা, যেন আল্লাহ আমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছি। এই পর্যায়ে পৌঁছুতে না পারলে অন্তত এটুকু কল্পনা করা, আমি আল্লাহকে দেখতে না পেলেও, আল্লাহ আমাকে দেখছেন।
সূরাতুল কাওসার!
মূলবক্তব্য: নবিয়ে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহ ও প্রভূত কল্যাণ দান।
আল্লাহ তাআলা নবিয়ে করিমকে দুনিয়া আখেরাতে অগণিত নেয়ামতে ভূষিত করেছেন। অন্যতম একটি নেয়ামত হল: নহরে কাওসার। এজন্য রাসুলকে আল্লাহর শুকরিয়াস্বরূপ নিয়মিত সলাত আদায় ও পশু কুরবানি করতে বলা হয়েছে। রাসুলের শত্রুদের চরমভাবে লাঞ্ছিত অপদস্থ করা হয়েছে। রাসুলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারীদের দুনিয়া-আখেরাতে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অন্যদিকে রাসূলের মুবারক নাম কেয়ামত পর্যন্ত মিনারে-মিম্বরে সসম্মানে উচ্চকিত রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
সূরাতুল কাফিরূন!
মূলবক্তব্য: মুশরিকদের ভ্রান্ত উপাস্য ও ধর্ম থেকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়মুক্তি।
এটা তাওহিদের সুরা। ভ্রষ্ট ও মুশরিকদের থেকে দায়মুক্তির সুরা। মুশরিকরা রাসুলের কাছে শান্তি ও সমঝোতা চুক্তির প্রস্তাব পেশ করেছিল। তাদের দাবি ছিল, একবছর রাসুল তাদের ভ্রান্ত উপাস্যের পূজা করবেন, আরেক বছর তারা রাসুলের উপাস্যের ইবাদত করবে। তখন সুরা কাফিরুন নাযিল হয়েছে। এই সুরার মাধ্যমে কাফেরদের হাস্যকর প্রস্তাব উড়িয়ে দেয়া হয়। মক্কার লোকজন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে: ঈমানদার আর মূর্তিপূজারি। কেয়ামত পর্যন্ত এই সুরা মুমিন ও কাফেরের মাঝে বিভক্তি রেখা হিসেবে থেকে যাবে।
সূরাতুন নাসর!
মহান মক্কা বিজয়ের কথা বলা হয়েছে। এই বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের ইজ্জত ও শক্তি আশাতীত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। পুরো জাযিরাতুল আরবে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ার অবাধ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মুশরিক ও ভ্রান্ত দলমতের বিষদাঁত ভেঙে গিয়েছিল। মানুষ দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। ইসলামের সমুন্নত বিজয়কেতন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মূর্তিপূজা ও ধর্ম নিষ্প্রভ হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মক্কা বিজয়ের আগেই এই সুরার মাধ্যমে আগাম সুসংবাদ জানিয়ে দেয়া হয়েছিল। এটা নবিজির সত্যতারও প্রমাণ। নবিজিকে বাকি জীবন তাসবিহ, তাহমিদ ও ইস্তেগফারে কাটাতে বলা হয়েছে। এই সুরা নাযিল হওয়ার পর থেকে নবিজি তাসবিহ, তাহমিদ ও ইস্তেগফার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। রুকু-সিজদায় বেশি বেশি পড়তেন,
سُبْحَانَكَ اللهمَّ ربَّنا وَبِحَمْدِكَ، اللهمَّ اغفِرْ لِيْ
আল্লাহুম্মা! ইয়া রাব, আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
সূরাতুল লাহাব!
মূলবক্তব্য: আল্লাহ ও রাসুলের শত্রু আবু লাহাবের ধ্বংস।
আবু লাহাব এই উম্মতের ফেরাওন। সে ছিল রাসুলের ঘোরতর শত্রু। সে নিজের কাজকর্ম বাদ দিয়ে সারাদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পেছনে লেগে থাকত। দাওয়াতি কাজে বাধা দিত। মানুষকে ঈমান থেকে বিরত রাখতে সদা তৎপর থাকত।
আবু লাহাবকে আখেরাতে লেলিহান শিখাময় আগুনে পুড়িয়ে ঝলসে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। তার স্ত্রীকেও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার জন্য বাড়তি ভিন্নধর্মী আযাবেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তার গলায় আগুনের রশি বেঁধে তাকে জাহান্নামে টানাহ্যাঁচড়া করা হবে।
সুরা লাহাবে আল্লাহর এক বিস্ময়কর আয়াত আছে। এই সুরা যখন নাযিল হয় তখনো আবু লাহাব ও তার স্ত্রী জীবিত। সুরায় বলা হয়েছে, দুজনের জন্য জাহান্নাম অনিবার্য। দুই নরাধম চাইলে ইসলাম গ্রহণ করে, সুরাটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে পারত। তা হয় নি। আল্লাহ জানতেন, দুই পাপিষ্ঠ কাফের অবস্থাতেই মারা যাবে। এই ঘটনা আল্লাহর গাইবি জ্ঞানের অন্যতম নিদর্শন।
সুরাটিতে ঈমানদারদের জন্যও সুস্পষ্ট এক বার্তা আছে। যারাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করবে, মুসলমানদের ক্ষতি করার অপচেষ্টা চালাবে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন। তাদেরকে ঝাড়েবংশে বিনাশ করবেন। তাদের এমন দশা করবেন, যাতে অন্যরা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
সূরাতুল ইখলাস!
এই সুরা পুরো কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য। কুরআনে মূলত তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে: তাওহিদ, আহকাম ও কাসাস। এই সুরায় অল্পকথায় তাওহিদকে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাওহিদ মানে আল্লাহ তাআলা এক, এই আকিদাবিশ^াস। তাওহিদ কুরআনি আলোচ্যবিষয়ের এক তৃতীয়াংশ। আল্লাহর এককত্বের প্রমাণও পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। সবাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী। দরকারে-প্রয়োজনে একমাত্র আল্লাহর কাছেই চাওয়া হয়; অন্য কারো কাছে নয়। যাবতীয় পূর্ণতার সিফাত একমাত্র আল্লাহ তাআলার। আল্লাহই সর্বদা মাখলুকের চাওয়া-পাওয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। তিনি সবধরণের অপূর্ণতা থেকে পবিত্র। একমাত্র আল্লাহ তাআলার আসমা ও সিফাতই পূর্ণতার চূড়ান্ত শীর্ষে পৌঁছেছে। তিনিই এককভাবে সার্বিক পূর্র্ণতার বৈশিষ্ট্য ধারণ করেন।
এমন সত্ত্বার প্রতিই অন্তর মহব্বতে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তাকে দেখে দৃষ্টি পরম তুষ্টি লাভ করে। তার কালাম শুনে কান শীতল হয়। তার মহব্বত ছাড়া জীবন অর্থহীন। তার দাসত্ব ছাড়া জীবন মূল্যহীন। দিবানিশি তার আনুগত্য ছাড়া জীবন ছন্নছাড়া। তার সমকক্ষ, সমতুল্য কেউ নেই। তাঁর কোনো সন্তান নেই। তিনিও কারো সন্তান নন। ঈসার মতো মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া কোনো মানুষও আল্লাহর মতো ইলাহ নয়। এই সুরায় খিস্টানদের ত্রিত্ববাদ রদ করা হয়েছে। মুশরিকদের বহু উপাস্যের ধারণা রদ করা হয়েছে।
সূরাতুল ফালাক!
বান্দা কীভাবে রহমান রহিমের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করবে, তিন ধরণের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে, তা শেখানো হয়েছে। তিন অনিষ্ট,
ক. সময়ের অনিষ্ট, বিশেষ করে রাতে ছড়িয়ে পড়া অনিষ্ট (৩)।
খ. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা সৃষ্ট অনিষ্ট, বিশেষ করে জাদুর অনিষ্ট (৪)।
গ. প্রাণ, বদ আত্মা, রূহের অনিষ্ট, বিশেষ করে হিংসার অনিষ্ট।
সূরাতুন নাস!
সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও ভয়ংকর শত্রু ইবলিস ও চেলাচামু-ার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ইবলিসের দুইরকম চেলা আছে। জিন চেলা, মানুষ চেলা। তারা মানুষকে নানাভাবে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে। মানুষের মনে কুমন্ত্রণা, ওয়াসওয়াসা দেয়। মানুষকে মন্দকাজে প্ররোচনা দেয়। এই সুরায় আল্লাহ তিন প্রকার তাওহিদের কথা বলেছেন। আল্লাহ কি? তিনি মানুষের রব, মানুষের মালিক, মানুষের ইলাহ। এই তিন তাওহিদ ঠিক থাকলে, আল্লাহ মানুষকে সিরাতে মুস্তাকিম দান করেন। যার কথা সুরা ফাতিহাতে বলা হয়েছে। সেখানে আল্লাহর কাছে সিরাতে মুস্তাকিম প্রার্থনা করা হয়েছিল। এখানে সিরাতে মুস্তাকিম লাভের উপায় বলে দেয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা গেছে, পুরো কুরআন একসুতোয় গাঁথা।